মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন চলে আসা কিছু বিষয় উভয় দেশের কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাঁধা সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে উভয় দেশের সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে বাংলাদেশ থেকে ফ্রেশ কর্মী নিবে মালয়েশিয়া। এজন্য বাংলাদেশকে লেবার সোর্স কান্ট্রির স্বীকৃতি দিয়েছে এবং জিটুজি প্লাসের পর আবারো ৫ বছর মেয়াদী চুক্তি করেছে। এ চুক্তি বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার কর্মী প্রেরণ ও গ্রহণের প্রতিষ্ঠানগুলোকে দারুণভাবে আশান্বিত করেছে যে এবার ব্যবসা করতে পারবে।
জি টু জি প্লাস চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সি (জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো-বিএমইটির হিসাব মতে ৩০০ টি রিক্রুটিং এজেন্সি) মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠিয়েছে দশটি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে। অর্থাৎ বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো রীতিমত ব্যবসা করেছে কিন্তু বঞ্চিত হয়েছেন মালয়েশিয়ায় লাইসেন্সধারী রিক্রুটিং এজেন্সি। বর্তমান চুক্তি উভয় দেশের রিক্রুটিং এজেন্সি ব্যবসা করার সুযোগ পাবে। ব্যাবসা করার জন্য এসব রিক্রুটিং এজেন্সি অনুমোদন পেয়েছে।
কর্মী প্রেরণের জন্য রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর এত তোড়জোড়ের মূল কারণ হলো কর্মী প্রেরণ করলেই লাভ এবং এটাই স্বাভাবিক। যাকে শ্রম মার্কেটিং বা শ্রম বাজার বলা হয়ে থাকে। এর ফলে গ্রামের সাধারণ যুবকের বৈদেশিক কর্মংস্থান হচ্ছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং রেমিটেন্স আয় করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রিক্রুটিং এজেন্সির ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই সরকারও আশা করে রিক্রুটিং এজেন্সি ব্যবসা অব্যাহত রাখবে। কিন্তু ইদানিং নানান কারণে বৈদেশিক কর্মসংস্থান আশানুরূপ করতে পারছে না।
অত্যধিক রিক্রুটিং এজেন্সি থাকায় নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে। এই প্রতিযোগিতা যেখানে কর্মী প্রেরণ করবে সেখানেও আছে। এজেন্সি সে দেশে ভিসা ক্রয় করে সরাসরি বা প্রতিনিধি বা দালাল বা অন্য কারো থেকে এতে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। আবার বাংলাদেশেও কর্মী পেতে দালাল, প্রতিনিধি ইত্যাদির উপর নির্ভর করতে হয়, এ ক্ষেত্রেও অর্থ খরচ করতে হয়। কর্মী প্রেরণকারী দেশে অনুমতি বা ভিসা বের করতে ধাপে ধাপে অর্থ খরচ যেমন করতে হয় তেমনি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধাপে ধাপে অর্থ বিনিয়োগ করতে হয় নইলে সময় মত কর্মী প্রেরণ করতে পারবে না। আর কর্মী প্রেরণ করতে না পারলে ব্যর্থ এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং ব্যাপক আর্থিক ও সুনামের ক্ষতি হয়।
তাই যে যেমন পারে এই অর্থ নিয়োগকারী এবং বিদেশগামী কর্মীর নিকট থেকে আদায় করে। অর্থাৎ বিদ্যমান কর্মী রিক্রুট, নিয়োগ, প্রেরণ এবং কর্মসংস্থানের দুঃখ কষ্ট এবং রক্তক্ষরণ সহ্য করতে হচ্ছে কর্মিকেই। এই কর্মী বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিক যে কি না বিদেশে কাজ পেতে লক্ষ লক্ষ টাকা ( জমি, বাড়ি, সোনা ইত্যাদি বিক্রি করে) নগদ দিয়ে থাকে। পাঠাতে ব্যর্থ হলে এই অর্থ ফেরত পায় না ফলে পরিবার চরম বিপদে পরে তখন রিক্রুটিং এজেন্সি বা মন্ত্রণালয় কেউই এদের পাশে দাড়ায় না ফলে এরাও কর্তৃপক্ষকে বিশ্বাস করে না। অর্থাৎ ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা রয়েছে।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ২০০৬/০৭ সালে মালয়েশিয়ায় উভয় দেশের রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে অত্যধিক বাংলাদেশী কর্মীকে মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে দেওয়া হয়, যাদের কাজ বেতন থাকা খাওয়া সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়েই প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় মালয়েশিয়া যেতে অনুমতি দিয়েছে অর্থাৎ যেন জোর করেই ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। মালয়েশিয়ায় যাবার পর না ছিল নিয়োগকর্তা, না থাকার জায়গা, না কাজ অর্থাৎ অমানবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে মালয়েশিয়াকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জবাব দিতে হয়। এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ থেকে প্রেরণকারী কোন রিক্রুটিং এজেন্সিকে পায়নি মালয়েশিয়া সরকার এমন অভিযোগ রয়েছে।
তখন মালয়েশিযা ডাম্পিং গ্রাউন্ড হয়েছিল এবং এবার যাতে না হয় সে কথায় বলেছেন মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী। মালয়েশিয়ার পার্লামেন্টে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সে অমানবিক অব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতায় মালয়েশিয়া জি টু জি প্লাসের সময় মাত্র ১০ টি বাংলাদেশী এজেন্সিকে প্রেরণের অনুমতি দেয়। মালয়েশিয়া সরকার নিজ দেশের রিক্রুটিং এজেন্সিকে বিরত রাখতে সমর্থ হয় সুন্দর ব্যবস্থাপনার কারণে। এর সুফল পেয়েছে মালয়েশিয়া কাজ না পাওয়া এবং অমানবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় নি। কোন কর্মীর বিপদে বা সমস্যা হলে দশটি রিক্রুটিং এজেন্সি পাশে পেয়েছে এমন জানা গেছে। ব্যবস্থাপনার এমন সফলতার কারণে এবারও নির্দিষ্ট রিক্রুটিং পদ্ধতি বেছে নিয়েছে মালয়েশিয়া সরকার এবং মেনে নিতে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করেছে।
মালয়েশিয়া সরকার দেওয়া প্রক্রিয়া বাংলাদেশ মেনে নিলেও রিক্রুটিং এজেন্সির বিরোধিতায় আর এগুতে সাহস পায় নি। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী এবং সচিব বারবার বলেছেন গতবারের মত কোন সিন্ডিকেট করবেন না। তাই এবার দশটি থেকে ২৫ টি এজেন্সি বৃদ্ধি করেছে মালয়েশিয়া আর বাংলাদেশ বলেছে ২৫০ টি যোগ করতে অর্থাৎ ২৭৫ টি এজেন্সি হবে । জি টু জি প্লাসের সময় তিন শতাধিক এজেন্সি প্রেরণ করে , সে হিসেবে এবার এজেন্সি সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তবে মালয়েশিয়া সরকার দশটি এজেন্সির নামে পাওয়ার অব এটর্নী এবং ডিমান্ড লেটার দেওয়ায় বাকি এজেন্টকে ঐ দশটি এজেন্টকে নানান ভাবে হেনস্থা, হয়রানি এবং অপমানের সম্মুখীন হতে হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই এবারও তেমন ব্যবস্থাপনা চাচ্ছে না কেউই।
অপর দিকে আর্থিক দিক দিয়ে দেখা গেছে দশটি রিক্রুটিং এজেন্সি বসে বসে অর্থ আয় করেছে । এই বসে বসে অর্থ আয়ের সুযোগ এবার সবাই পেতে সোচ্চার হয়েছে। সিন্ডিকেট পক্ষে বিপক্ষে বা নিরপেক্ষ যেই হোক না কেন তাদের সবারই একই লক্ষ্য সে সুযোগ পাওয়া। সে সুযোগ পেতেই নানান স্লোগান, মিটিং চলছে।
মালয়েশিয়া কর্মী ব্যবস্থাপনায় সুনির্দিষ্ট পথ ঠিক করলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমন দেখা যায় নি! প্রথম জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভা থেকেই বাংলাদেশ কর্মীদের ডাটাবেস, আগেই নাম নিবন্ধন, ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা দেয়া, মেডিকেল, অনুমোদন ইত্যাদি ইত্যাদি করার কথা বলে কিন্তু কোনটিই বাস্তবে দেখা যায়নি। ইদানিং বিদেশে যেতে ইচ্ছুক কর্মীদের নাম নিবন্ধন করার বিজ্ঞপ্তি দেখা গেছে এবং বিএমইটি বাদ দিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়ায় নানান প্রশ্ন দেখা দিলেও কাজ চলছে। এটি নিয়ে মালয়েশিয়া কি বলে সেটা হয়ত এই সভায় উঠে আসবে। কিন্তু অন্যান্য বিষয় নিয়ে তেমন কোন বাস্তব কিছু না দেখানোর সম্ভাবনা বেশি। দালালদেরকে নিয়মের মধ্যে আনার কথাও শোনা যায়।
গত প্রবাসী কল্যাণ সচিব বাংলাদেশ রিক্রুটিং এজেন্সির পারফরমেন্স অনুযায়ী গ্রেডিং করার বিধি জারি করে মন্ত্রণালয় ছাড়তে হয়েছে। এসব দেখে অভিবাসন বিষয়ক বিজ্ঞ জনেরা বলেছেন ” সরকার না চাইলে সম্ভব না এসব অনিয়ম দূর করা।” বাংলাদেশের প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময় এসব দালাল, চাকরি না পাওয়া, প্রতারণা ইত্যাদির কথা বলেন কিন্তু বাস্তবে সে সব দেখা যায় না। ইতিহাস অনুযায়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে বাংলাদেশ কর্মী প্রেরণ করলেও অদ্যাবধি ভালো কোন ব্যবস্থাপনা কেউই উপহার দিতে পারে নি।
কর্মীরা টাকা যত লাগুক দিয়ে বিদেশ যায় এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য । ফলে দেখা যায় উভয় দেশের সরকার চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত বা তার থেকে কম খরচে কখনোই কর্মী বিদেশে যেতে পারে নি বরং কয়েক গুণ বেড়েছে। যেমন বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী যাবার চুক্তি ছিল ৪০ হাজার টাকা সেটি সরকার নিজেই বৃদ্ধি করে ১ লক্ষ ৬৫ হাজার করেছিল এবং সেটাও বহাল থাকে নি ৪/৫ লক্ষ টাকায় ঠেকেছিল। এতে যে সরকারের কোন নিয়ন্ত্রন নেই সেটি স্পষ্ট বরং সরকার নিজেই বৃদ্ধি করে দিয়েছে। তাই এবারও অভিবাসন খরচের অংক যতই থাকুক না কেন শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে এবং একেক এজেন্সি একেক ধরনের চার্জ করতে পারে এমন আশঙ্কা রয়েছে।
মালয়েশিয়া সরকার অভিবাসন খরচের সমস্যায় ভুগছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রান্তে সে দুঃখের ভাগীদার কেউ নেই এমনটাই দেখা যাচ্ছে। ফলে মালয়েশিয়া খুব সতর্ক । নিয়োগকর্তারা জিরো কষ্ট বা বাংলাদেশ প্রান্তেও সকল খরচ দিতে আগ্রহী। কিন্তু বাংলাদেশে যে অতিরিক্ত খরচ হবে না এ নিশ্চয়তা পাচ্ছে না নিয়োগকর্তারা এমনটা জানা গেছে। সে দিকেও নজর দেবার তাগিদ আছে। তবে সকলের দৃষ্টি এখন সভার দিকে।
আহমাদুল কবির: : মালেয়শিয়া প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক