ক্যান ডু স্পিরিট এবং একজন জেনারেল

দক্ষিণ কোরিয়া দেশটি পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত একটি প্রযুক্তি মুন্সিয়ানার দেশ। লোক সংখ্যা পাঁঁচ কোটি দশ লাখ। আয়তন এক লক্ষ চারশত বর্গ কিলোমিটার। ১৯৮০ সালের গণ বিদ্রোহ, অভাব অনটন লেগেই ছিল। সব কিছর পরও কোরিয়ায় চলছে অর্থনীতির রকেট গতিতে। ওয়ার্ল্ড ডাটা এটলাসের তথ্য অনুযায়ী কোরিয়া ২০২০ সালে-৭ম এক্সপোর্টার দেশ। এশিয়ার তৃতীয়, আর বিশ্ব অর্থনীতিতে এর অবস্থান দ্বাদশ। নেই তেল, গ্যাস, খনিজ।

কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির সুপার হওয়ার জন্য রয়েছে অপরিমিত সততা, কর্মদক্ষতা।পৃথিবীতে শিক্ষায় কোরিয়ার অবস্থান ১৫ তম। ইলেকট্রনিকস, অটো মেকানিক আর জাহাজ শিল্প বিশ্বে নেতৃত্ব আছেই। গ্লোবাল শিপবিল্ডিং মার্কেটের ৯০% কোরিয়া,জাপান ও চীনের দখলে।

প্রিয় পাঠক আমরা জানি কোরিয়া যুদ্ধে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি। অবকাঠামো বলতে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। কোরিয়া ছিল তখন গরীব জীর্ণ শীর্ণ দেশ । কিন্তু এই দেশটি হঠাৎ করে সারা বিশ্বের বুকে শক্তিশালী দেশে পরিণত হয় কি করে? আর এই শক্তিশালী অর্থনৈতিক সুপারপাওয়ার হবার পেছনে রয়েছে কি জীয়নকাঠি? সে প্রাণখোলা ইতিহাস জানতে যেতে হবে একটি মহাসড়কের কাছে!

Travelion – Mobile

কোরিয়াকে পরিবর্তন করে দেয় একটি মহাসড়কই। নাম গিয়ংবু এক্সপ্রেসওয়ে। সালটি তখন ১৯৬৩। ভঙ্গুর কোরিয়ার ক্ষমতায় আসেন জেনারেল পার্ক চুং হে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন কোরিয়ার রাজধানী সিউলের সাথে দ্বিতীয় বৃহৎ শহর ও বন্দরনগরীকে বুসানকে যুক্ত করবেন। সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করা হয় গিয়ংবু এক্সপ্রেসওয়ের। এই এক্সপ্রেসওয়েতে তিনি যুক্ত করতে চান দেশের প্রধান শহর গুলিকে। এগুলো হলো দেজন, গুমি, দেগু এবং বুসান।

অভাবের দেশ,পর দেশে শ্রম দেয়া দেশ, এরকম বিলাসবহুল প্রকল্প হাতে নেয় কোন সাহসে। পার্কের এই প্রকল্পের বিরোধিতা করেছিলেন তৎকালীন অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ,মূলধারার রাজনীতিবিদ এমনকি সাধারণ জনগণ। ফুঁসে উঠে হয় অনেক সমালোচনা, মহাসড়কটি করতে গিয়ে কোরিয়া বিশ্ব ব্যাংকসহ বিভিন্ন দেশের দ্বারস্থ হয়। কিন্তু একে একে কোরিয়াকে সবাই ফিরিয়ে দেয়।

আন্তর্জাতিক সংস্থা পাশে না থাকলেও দক্ষিণ কোরিয়া তাদের নিজস্ব অর্থায়নে, প্রযুক্তিতে এবং জনবলে এরকম একটি প্রকল্প করতে সক্ষম। সালটি ১৯৬৭। দক্ষিণ কোরিয়ার মোট বাজেটের ২৩.৬ শতাংশ বরাদ্ধ করা হল এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য। ১৯৬৮ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি শুরু হল এই মহাযজ্ঞের উন্নয়ন মুখী কাজ। দুর্গম পথে বিরতিহীন অক্লান্ত পরিশ্রম চলতে থাকল। ক্রমেই এগোতে লাগল এই প্রকল্প।

মাত্র ২ বছর ৫ মাসে শেয় হয় এই প্রকল্পের কাজ৷ বলা চলে অল্প সময়ে। প্রকল্পের পথে পাহাড়ি দূর্গম অঞ্চল প্রচুর। ৪২৮ কিমি এই সড়কে রয়েছে ২৯ টি বড় ব্রিজ, ১২ টি টানেল এবং ১৯ টা ইন্টারচেঞ্জ।

এই মহাসড়ক নির্মাণে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেছিল ৮৯ লক্ষ মানুষ। সড়ক নির্মাণে প্রায় ১৬.৫০ লক্ষ যন্ত্রপাতি ব্যাবহার করা হয়েছে। সেই আমলে খরচ হয়েছে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন ডলার যা এখনকার সময়ের কয়েক বিলিয়ন ডলারের সমান। সড়কটি নির্মাণে প্রাণ হারিয়েছিল ৭৭ জন মানুষ। আহত হয়েছিল অগণিত।

৭ জুলাই, ১৯৭০, এই সড়কটি উদ্বোধন করা হয়। কথা হচ্ছে কি পেয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া এই এক্সপ্রেসওয়ে করে?

দেশটির প্রায় ৬৩% জনগণ এই রাস্তার মাধ্যমে দ্রুত যোগাযোগের সুবিধা পায়। কোরিয়ার গড়ে উঠে হাজার হাজার শিল্প কারখানা যার ভেতর ৮১% কারখানা যুক্ত হয় এই সড়ক কে ঘিরে। দক্ষিণ কোরিয়া পরিণত হয় সারা বিশ্বের অন্যতম কন্সট্রাকশান জায়ান্ট হিসাবে।

সেই আমলের এরকম অসাধ্য সাধন কে কোরিয়ারা বলে থাকে Can Do spirit অর্থাৎ, আমরা পারবই। হুন্দাই কোম্পানিকে চেনেনা এমন লোক কম আছে। হুন্দাই কোম্পানির যাত্রা শুরু হয় এই মহাসড়ক নির্মাণে যুক্ত থেকেই।

“আমরা পারবই” এই প্রত্যয় থেকেই কোরিয়াতে গাড়ি নির্মাণ, বিমানবন্দর নির্মান, স্টিল মিল নির্মাণের মত কাজ শুরু হতে থাকে যার প্রধান শক্তি ছিল এই প্রকল্প থেকেই। আর এ সড়কটিই বদলে দিতে থাকে দক্ষিণ কোরিয়ার ভঙ্গুর অর্থনীতিকে। বুসান শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় হাজার হাজার কলকারখানা। আর এ থেকে দক্ষিণ কোরিয়া দুর্বল অর্থনীতির দেশ থেকে পরিণত হয় টাইগার অর্থনীতির দেশে।

২০১৮ সালের পরিসংখ্যান বলছে, দক্ষিণ কোরিয়া তাদের মোট জিডিপির ৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ বা ৬৯ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার মানে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা শুধুমাত্র একবছরে শিক্ষা ও গবেষণায় খরচ করে সবাইকে পেছনে ফেলেছে!বিজনেস কোরিয়ার তথ্যমতে বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতি ১০০০ জন কর্মঠ মানুষের মধ্যে ১৪ জন (মোট জনসংখ্যার ১০০০ জনে ৭.৪ জন) সরাসরি গবেষণার সাথে জড়িত।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গণমাধ্যম ব্লুমবার্গের সর্বশেষ উদ্ভাবনী সূচকে বিশ্বের সেরা দ্বিতীয় উদ্ভাবনী দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া দেশ দক্ষিণ কোরিয়া। যদিও গত ছয় বছর লাগাতার প্রথম হওয়ার রেকর্ড দক্ষিণ কোরিয়ার। এই সূচকে মোট ৬০টি দেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

তালিকাটি তৈরিতে গবেষণা, উন্নয়ন ব্যয়, উৎপাদন ক্ষমতা এবং উচ্চমানের প্রযুক্তি বিকাশে সরকারি সংস্থাগুলোর সক্ষমতাকে সূচকের মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

সে মানদন্ডে ২০২০ সালে দক্ষিণ কোরিয়া দ্বিতীয়। এশিয়ার এই ‘টাইগার ইকোনমি কান্ট্রি থেকে বাংলাদেশের অনেক শেখার আছে।

লেখক : সাংবাদিক

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!