কোরিয়ায় বাংলাদেশি নিষেধাজ্ঞা, এড়ানো কী যেত না

বাংলাদেশ থেকে যাওয়া যাত্রীদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশি নাগরিকদের উপর দ্বিতীয়বারের মতো ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। শুক্রবার (১৬ এপ্রিল) থেকে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে।

একই কারণ দেখিয়ে গত বছরের ২৩ জুন থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা নিষেধাজ্ঞা এবং বিমান চলাচল স্থগিত করেছিল কোরিয়া সরকার। ফলে কোরিয়া গমনেচ্ছুক বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এবং ইপিএস কর্মীর ভবিষ্যত হুমকির মূখে পড়ে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সিউলে বাংলাদেশ দূতাবাস সেই ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে জন্য কোরিয়া সরকারের সঙ্গে দেনদরবার শুরু করে। নিরবচ্ছিন্ন কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে দীর্ঘ ৮ মাস পর বাংলাদেশের নাগরিকদের ওপর আরোপিত ভিসা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় কোরিয়া। গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতার শর্তে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা দেওয়া শুরু করে ঢাকার কোরিয়ান দূতাবাস ।

দূর্ভাগ্যের বিষয় নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ৬৯ দিনের মাথায় কোরিয়া আবারোও ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এমন পরিস্থিতির জন্য দায় কার। সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর উদাসীনতা কিংবা সমন্বয়হীনতা নাকি কোরিয়াগামীদের অসতর্কতা এ নিয়ে চলছে বিতর্ক। বিতর্ক যাই হোক বাংলাদেশের শ্রমবাজার যে আবারও অনিশ্চয়তার দোলাচালে পড়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

Travelion – Mobile

গত ৮ ফেব্রুয়ারি ভিসা সুযোগ পাওয়ার পর এ পর্যন্ত কোরিয়ায় পৌঁছে করোনা পজিটিভ সনাক্ত হয়েছেন ৩৩ জন বাংলাদেশি । এর মধ্যে মার্চে ১৭ জন এবং চলতি এপ্রিলের ১৫ তারিখ পর্যন্ত ১৬ জন কথা জানা গেছে।

প্রথমবার ২৩ জুন কোরিয়ার সরকার বাংলাদেশের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারির খবরটি কোরিয়ার গণমাধ্যমে প্রকাশ করে। সে সময় আমি কোরিয়ায় অবস্থান করায় নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে নানা প্রতিবেদনের মাধ্যমে তুলে ধরি। বর্তমান উচ্চতর ডিগ্রীর জন্য আমি জার্মানিতে অবস্থান করলেও কোরিয়ার শ্রমবাজার, বাংলাদেশিদের খোঁজ খবর নিয়মিত রাখছি। সবশেষ নিষেধাজ্ঞার দুঃসংবাদটিতে আহত হলেও অবাক হয়নি। কারণ এমনটি হওয়ার আভাস আগেই পাওয়া গিয়েছিল।

প্রথম নিষেধাজ্ঞার সময় বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানকেও অর্ন্তভূক্ত করেছিল কোরিয়া সরকার। এরপর একে একে ছয়টি দেশ নিষেধাজ্ঞায় পড়ে। পাকিস্তানে কোভিড পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ায়, সিউল ইসলামাবাদের ভিসা আবেদন আবার চালু করে। এখনো পাকিস্তানের জনগণ কোরিয়ায় প্রবেশ করছে। কথা হচ্ছে, প্রতিমাসে পাকিস্তান থেকে করোনা রোগী কি যাচ্ছে না, উত্তর হচ্ছে হ্যা, তবে কোন মাসে একজন, কোন মাসে দুইজন। বাংলাদেশর মতো ১৬/১৭ জন নয়!

দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশে আবারও ভিসা নিষেধাজ্ঞায় পড়তে পারে বাংলাদেশ এমন আশংকা করেছিল খোদ কোরিয়া সরকার। গত ৫ এপ্রিল ঢাকার দক্ষিণ কোরিয়া দূতাবাসের ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজে দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, ‘কোভিড-১৯ নেগেটিভ সার্টিফিকেট থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে কোভিড-১৯ পজিটিভ পাওয়া যাচ্ছে। ২০২১ সালের মার্চের শেষে সংক্রমণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে যা, কোরিয়ান কর্তৃপক্ষের জন্য গুরুতর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

বিজ্ঞপ্তিতে কোরিয়ান দূতাবাস ভিসা স্থগিতাদেশের মতো পরিস্থিতির আশঙ্কার কথাও জানিয়েছিল এবং তার ফলাফল অন্য বাংলাদেশিদের জন্য মারাত্মক হতে পারে বলে সর্তক করেছিল। দূতাবাস কোরিয়াগামী বাংলাদেশিদের সর্বোচ্চ সতর্ক ব্যবস্থা নিশ্চিতের জন্য যাত্রার আগে ২ সপ্তাহের কোয়ারেন্টিনে থাকার পরামর্শও রেখেছিল।

অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের উপর বার বার জোর দিয়ে আসছিল কোরিয়াস্থ বাংলাদেশিদের সংগঠন ইপিএস বাংলা ইন কোরিয়া। কূটনৈতিক সূত্র থেকে জানা যায়, সিউলে বাংলাদেশ দূতাবাসও বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে বারবার চিঠি দিয়েও কোরিয়াগামীদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত বিষয়ে অনুরোধ জানিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে থেকে গত কয়েক মাসে এ নিয়ে কোন তোড়জোড় দেখা যায়নি।

কোরিয়ান দূতাবাসের ৫ এপ্রিলের বিজ্ঞপ্তির সূত্র ধরে গত সপ্তাহে দি ডেইলি স্টারে প্রকাশিত দীর্ঘ প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছিল, যেখানে সংশ্লিষ্টদের বরাতে নিষেধাজ্ঞার আশংখা এবং এড়াতে জরুরীভিত্তিতে উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে মতামত রাখা হয়েছিল। তেমন কোন জরুরী পদক্ষেপের খবর কানে বাজেনি।

ডেইলি স্টার অনলাইনের খবরের সূত্রে জানতে পেরেছি, গত সোমবার ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রলায় বৈঠকে নাকি কোরিয়াগামী বাংলাদেশিদের জন্য যাত্রার আগে দেশে কোয়ারেন্টিনের বাধ্যবাধকতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু তা এখনো এমন কোন নোটিশ প্রকাশিত হতে দেখিনি। আন্তঃমন্ত্রলায় বৈঠকটি যদি আরো আগে হতো এবং এর বাস্তবায়ন যদি সময়মতো হতো নিঃসন্দেহে বলা যায় এই দুঃসংবাদ শুনতে হতো না।

আমরা যতটুকু জানি আগের নিষেধাজ্ঞা তোলার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল সর্বোচ্চ সতর্ক ব্যবস্থা নিশ্চিত। ধারাবাহিকভাবে যখন করোনা পজিটিভ পাওয়া যায় তাতে পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে প্রতিশ্রুতি পুরোপুরি রক্ষা হয়নি। এ জন্য শনাক্তদের সচেতনতার অভাবকে দায়ী করা হচ্ছে। কিন্তু তাদের মনিটরিং করা, সর্বোচ্চ সতর্ক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা তো সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ছিল। তাই আমরা মনে করি আবারও নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে আটকানোর পেছনে সংস্থাগুলো দায় কোনভাবেই কম নয়।

জোর দিয়েই বলতে পারি, সর্বোচ্চ সর্তক ব্যবস্থা নিশ্চিতে কোরিয়াগামীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হলে, সরকারি তত্ত্বাবধানে ১৪ দিন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখলে এই নিষেধাজ্ঞা এড়ানো যেত। বাংলাদেশের শ্রমবাজার হুমকিতে পড়তো না। সে সঙ্গে ব্যবসাসহ নানা পেশায় কোরিয়াগামী বাংলাদেশিরা অনিশ্চয়তার দোলাচালে পড়ত না। কাজেই এর দায় খুঁজে বের করার জন্য সরকারকে উদ্যাগ নিতে হবে এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে সম্ভাব্য সবধরণের প্রচেষ্টা দ্রুত নিতে হবে।
লেখক : প্রবাসী সাংবাদিক

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!