যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশি পিতা-মাতার কিশোরী সন্তান কোরআনে হাফেজ মারইয়াম মাসুদ, সারা পৃথিবীর মুসলিম শিশু-কিশোর-তরুণ সমাজের আইকন। মাত্র ১৩ বছরের এই কিশোরীর ফেসবুক ও ইউটিউব মিলে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ১৫ লাখ ছাড়িয়েছে। তাকে নিয়ে দৈনিক প্রথম আলোর উত্তর আমেরিকা সংস্করণে লিখেছেন মনিজা রহমান। আকাশযাত্রা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল অনুকরণীয় এই গল্প ।
জন্মের আগে আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে অনাগত শিশু ডাউন সিনড্রোম নিয়ে জন্মাবে বলে আশঙ্কা ছিল চিকিৎসকদের। সেই আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণিত করে বাস্তবে শিশুটি পৃথিবীতে এসেছিল সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক। তখনই গর্ভাধারিনী মা নিয়ত করেছিলেন, এই সন্তানটিকে তিনি কোরআনে হাফেজ বানাবেন। বাস্তবে সেটাই হয়েছে। তাঁর মেয়ে শুধু ত্রিশ পারা কোরআন শরিফ মুখস্থ করেনি, এখন সে সারা পৃথিবীর মুসলিম তরুণ সমাজের আইকন। মাত্র ১৩ বছরের এই কিশোরীর ফেসবুক ও ইউটিউব মিলে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ১৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মারইয়াম মাসুদ। বাবা-মা আর তিন বোনের সঙ্গে সে বাস করে নিউজার্সির সমারসেটে। বাবা–মা দুজনেই বাংলাদেশি। বাবা মাসুদুর রহমানের বাড়ি বগুড়া আর মা শাকিলার বাড়ি দিনাজপুর। তবে মারিয়ামের জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা আমেরিকায়। ভিনদেশে, ভিন্ন সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা একটি শিশু মাত্র নয় বছর বয়সে কোরআনে হাফেজ হয়েছে। মাত্র তিন বছর বয়স যখন, তখনই ওর সুরেলা কণ্ঠের কোরআন পাঠ বিস্মিত ও মুগ্ধ করত সবাইকে। সাত থেকে নয়, দুই বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর অবশেষে মারইয়াম ত্রিশ পারা পবিত্র কোরআন মুখস্থ করেছে।
মারইয়াম এখন গাইড ইউএস টিভিতে ‘কোরআন উইথ মারইয়াম’ শীর্ষক শিশুদের একটি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করছে। মারইয়াম বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। ইউটিউবে তার ভিডিও দেখতে সবার খুব আগ্রহ। মারিয়ামের ভেরিফায়েড ফেসবুক ও ইউটিউব মিলে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ইতিমধ্যে ১৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। তার বেশির ভাগ অনুসারী আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যের।
মারিয়ামের বাবা মাসুদুর রহমান পেশায় একজন সফটওয়্যার আর্কিটেক্ট। ব্যারাইজন ওয়ারলেস টেকনিক্যাল টিমের সদস্য তিনি। তিনিই মেয়ের ইউটিউব ও ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দেন।
মারইয়াম বর্তমানে নিউজার্সির গভর্নর ফিল মারফির একটি প্রচার কাজে সাহায্য করছে। ‘ইন্টারফেইথ হিউম্যানেটারিয়ান’ কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত সে। কিছুদিন আগে একটি ইন্টারফেইথ ইভেন্টে অতিথি বক্তা হিসেবে অংশ নেয় মারইয়াম, যেখানে সিনেটর বব মেনেনডেজ ও কংগ্রেসম্যান ফ্রাঙ্ক পেলোনসহ বহু প্রভাবশালী ও বিখ্যাত মানুষ উপস্থিত ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার টেলিভিশন চ্যানেল ওয়ানফোরকিডস এবং মালয়েশিয়ান চ্যানেলে ‘ওমর’ ও ‘হানা শো’তে কাজ করে মারইয়াম। বিশ্বজুড়ে পিতৃমাতৃহীন শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংস্থা ইসলামিক রিলিফ ইউএসএর সম্মানিত দূত সে। সম্প্রতি সে সিরিয়া ও ইয়েমেনের এতিম শিশুদের জন্য ২৫ হাজার ডলার সংগ্রহ করেছে, যা বাংলাদেশি টাকায় ২১ লাখ।
বিশ্বকে পাল্টে দেওয়ার স্বপ্ন দেখে কোরআনে হাফিজা মারইয়াম মাসুদ। অনেকে বলেন, আজকালের দিনে দ্বীন ও দুনিয়ার মধ্যে সমন্বয় রাখা কঠিন। কিন্তু মারিয়াম সেটা করে দেখিয়েছে। সে যে শুধু কোরআনের আয়াত সুন্দরভাবে তিলাওয়াত করে, তা নয়, ধর্ম সম্পর্কেও গভীর ও প্রকৃত জ্ঞান রাখে।
পবিত্র কোরআনে হাফেজা হওয়ার জন্য মারইয়াম প্রথমে ধন্যবাদ জানায় আল্লাহ তায়ালাকে। তারপর অবশ্যই বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণার কথা উল্লেখ করে। অবাক ব্যাপার হল, মারিয়াম কোন নির্দিষ্ট হিফজের স্কুলে কখনো ভর্তি হয়নি। মায়ের মুখে শুনে কোরআন মুখস্থ করেছে সে। সেই কথা বলতে গিয়ে সে জানায়, ‘আমার মা প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছে আমার জন্য। আমাকে শেখানোর প্রস্তুতি হিসেবে মা তাজবিদ কোর্স সম্পন্ন করেছেন। নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে অধ্যয়ন করেছেন। এখনো তিনি আল মাগরিব ইনস্টিটিউটে অধ্যয়ন করছেন।’
মেয়েকে কোরআন মুখস্থ করানোর জন্য অনেক কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে মাকে। কারণ মাঝে মাঝে শিশু কন্যার মতো মনে হতো, এত লম্বা সুরা মুখস্থ রাখা খুব কঠিন। অনেক সময় সে বলত, আর পারবে না সে। তখন মারইয়ামের মা বলতেন, ‘চল একটা প্রতিযোগিতা করি। কে কত তাড়াতাড়ি এই পৃষ্ঠা মুখস্থ করতে পারি, যে পারবে সে–ই জয়ী হবে।’ এভাবে মা আর মেয়ের প্রতিযোগিতা চলত। কখনো মেয়ে বাড়িতে খেলা করছে, মা ঘরের কাজ করছেন। কাজ করতে করতেই মা তার মুখস্থ সুরাগুলো পাঠ করতেন, মেয়ে শুনে শুনে মুখস্থ করত। স্কুলে যাওয়ার সময় গাড়ির সিডিতে সুরা দেওয়া হতো। মারিয়াম কখনো মুখস্থ করত, কখনো মুখস্থ করা সুরাটা আবার ঠিক আছে কিনা দেখত। স্কুল থেকে আসার পথে একই কাজ করত সে। এভাবেই কাজটা সহজ হয়ে যায়।
স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি কীভাবে কোরআন চর্চা ও ইউটিউবে নিজের চ্যানেলে সময় দেয় মারইয়াম? বিষয়টা সহজ নয়। কিন্তু সে এই কাজটিকে সহজ করে নিয়েছে। বাসায় ফিরে প্রথমেই সে সব হোম ওয়ার্ক শেষ করে ফেলে। তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। এরপরে মাগরিবের নামাজ শেষ করে পবিত্র কোরআন নিয়ে বসে। মারইয়াম মনে করে, কোন কিছু পরিকল্পনার সঙ্গে নিয়মিত করতে থাকলে ফল পাওয়া যায়।
Umrah 2019:😢 Maryam recites Surat Al Hajj first 5 pages
MUST Share!! When Maryam Masud recites the Holy Qur'an heart only longs to meet our Creator, it finds tranquility as Almighty Allah says, "Verily in the remembrance of Allah do hearts find rest!" [13:28]Also watch Maryam reciting Surat Al-Araf at RIS: https://youtu.be/2QvPXPxKtrE 😢
Posted by Maryam Masud on Monday, January 13, 2020
ভবিষ্যতে ইসলামিক স্কলার হতে চান মারইয়াম, যাতে আগামী প্রজন্ম পবিত্র কোরআন পড়তে ও তার বাণীর সৌন্দর্য অনুধাবন করতে পারে। বাংলাদেশে কিংবা আমেরিকায় যারা বাঙালি আছেন, তাদের মধ্যে মেয়েদের কোরআনে হাফিজা হওয়ার সংখ্যা খুব কম। ভারত ও পাকিস্তানের মেয়েদের মধ্যে বরং কোরআনে হাফিজার সংখ্যা অনেক বেশি। বাংলাদেশের মানুষ অনেকেই বিশ্বাস করে, কোরআন শরিফে হাফেজ হওয়া শুধু পুরুষদের কাজ। এ নিয়ে মারইয়ামের অভিমত, ‘মহানবী (স.)–এর সাহাবিদের মধ্যে নারীরাও ছিলেন। যেমন আয়শা (রা.) অনেক নির্ভরযোগ্য হাদিস দিয়েছেন। আর ভুলে গেলে চলবে না খাদিজা (রা.) প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। ইসলামের মনীষী ও কোরআনে হাফেজ রাবিয়া বসরীর কথা সবাই জানে।
মারইয়াম মনে করে, কোরআন শরিফ মুখস্থ করা মানে সিঁড়ির প্রথম ধাপে আছে সে। এখন তাকে কোরআনকে বুঝতে হবে। তার অর্থ জানতে হবে। সেই মতো জীবন পরিচালনা করতে হবে।
মারইয়ামের বয়সী অন্য দশটি মেয়ের মতো সেও এখন অবসর পেলে ছোট বোনের সঙ্গে খেলা করে। আবহাওয়া চমৎকার থাকলে বাইক চালায় বোনের সঙ্গে। বড় বোন মাইশার সঙ্গে বাসার সামনে লনে ব্যাডমিন্টন খেলে, ট্যাবে গেমসও খেলে। তবে সবকিছু করে স্কুলের পড়াশোনা ও কোরআন পাঠ করার পর। পুরো কোরআনে মারইয়ামের সবচেয়ে প্রিয় সুরা হল সুরা আল ইউসুফ। কারণ এর একটা কাহিনি আছে।
নিউজার্সির সমারসেটে যেখানে মারইয়ামের জন্ম ও বেড়ে ওঠা, সেখান থেকে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে আসতে গাড়িতে সোয়া এক ঘণ্টার মতো লাগে। ২০০৬ সালের মার্চে জন্ম হয় তার। ছোট থেকেই তার মধ্যে অন্যরকম এক ক্ষমতা আবিষ্কার করতে পারে বাবা-মা। মুখস্থ রাখার অসামান্য ক্ষমতা ওর। মা শাকিলা ধর্মপ্রাণ একজন মানুষ। তিনি বেশ সময় দেন মেয়েকে। মূলত তার কারণে নয় বছর বয়সে কোরআনে হাফেজ হয় মারইয়াম। এর আগে মাত্র আট বছর বয়সে ইকনা কনফারেন্সে প্রায় ২০ হাজার মানুষের সামনে কোরআন তিলাওয়াত করে সে চমকে দেয় সবাইকে। মারইয়ামের কণ্ঠের গভীরতা ও মাধুর্য সবার হৃদয়কে স্পর্শ করে। বিশ্বজুড়ে এখন তার লাখ লাখ অনুসারী। পৃথিবীর যে প্রান্তেই যায়, হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে তাকে এক নজর দেখার জন্য।
এই মারইয়ামের আরেকটা পরিচয় আছে। দস্যু বনহুরের লেখক রোমেনা আফাজের প্রপৌত্রী সে। অর্থাৎ বাবা মাসুদুর রহমানের দাদি হলেন এই লেখক, যার রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনি ছিল এক কালে বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় আকর্ষণ। ২০১০ সালে স্বাধীনতা পদক পান লেখিকা রোমেনা আফাজ।
মারইয়ামের বড় বোন মায়িশা মাসুদ নিউজার্সির রাটগার ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করছে। ছোট বোন ফাতিমা মাসুদের বয়স মাত্র পাঁচ বছর। এই বয়সেই সে পবিত্র কোরআন শরিফের চার পারা মুখস্থ করেছে। বোন মারইয়ামের মতোই সে খুব ভালো বক্তা। বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিয়েছে এরই মধ্যে। মারইয়াম ও বোন ফাতিমা বহু দেশ সফর করেছে, যার মধ্যে আছে যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কানাডা, সৌদি আরব, ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ড। তাদের সফরের উদ্দেশ্য ছিল তরুণ সমাজের মধ্যে পবিত্র কোরআনের বাণী পৌঁছে দেওয়া।