কুয়েত : করোনা এবং ভিসা বাণিজ্য!
করোনাভাইরাসে সংকটে ভিসা বাণিজ্য ও মানবপাচারের মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েতে সমাজ ও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সে কারণে এই পরিস্থিতিতেও এ চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে গেছে দেশটির সরকার। এ নিয়ে সামগ্রিক পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন আরব টাইমসের বিশ্লেষক ইউসুফ আওয়াধ আল-আজমি।
করোনাভাইরাস সঙ্কট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সামনে এনেছে, আর তা হল ভিসা বাণিজ্যের কারণে কুয়েতের জননিরাপত্তা ও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা চরম হুমকিতে। এটি আমাদের সামনে আগের সরকারগুলোর ভিসা বাণিজ্য নিয়ে কঠোর মনোভাবের বদলে গা-ছাড়া ও হালকা মেজাজের মনোভাবকে তুলে ধরেছে যা জন্ম দিচ্ছে নানা প্রশ্নের।
ভিসা বাণিজ্যে এদেশের জন্য কোন নতুন বা অস্পষ্ট ব্যাপার নয়। আমাদের সকলেরই জানা আছে, এখানকার একটি বিশেষ এলাকা পুরোপুরি এমন ভিসা বাণিজ্যের শিকার শ্রমিকে ঠাসা। তারপরও এটি অনেকটা ওপেন সিক্রেটের মত কোন কারণ ছাড়াই উপেক্ষিত থেকে গেছে।
নিরপেক্ষ বিচারক হিসেবে আমাদের প্রথমে মেনে নেওয়া উচিত যে এই শ্রমিকরা দুঃসময়ের চক্রে এবং দুষ্ট আমলাতান্ত্রিক চোরাবালিতে আটকে গেছেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না এই দেশে তারা এসেছেন পরিবার পরিজন ছেড়ে। তারা দরিদ্র দেশের হলেও মানব সন্তান যারা নিজেদের এবং পরিবারের উন্নত একটি ভবিষ্যত নিশ্চিত করার জন্য এখানে সব কিছু বিসর্জন দিয়ে এসেছেন।
তাদের শুরুটা হয় লোভী স্পনসরের কাছে রয়্যালটি আকারে একটি বড় অঙ্কের টাকা পরিশোধ করে। সরকারি সংস্থাগুলো এক্ষেত্রে প্রকৃতভাবে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন না করে, নামকাওয়াস্তে ভূমিকা রেখেছে। তারা শ্রমিকদের চাকরি, কর্মপদ্ধতি ও যোগ্যতা ভালভাবে যাচাই না করার কারণে প্রতারণামূলক কর্মকান্ডেরসুযোগ তৈরি হয়। যারা প্রতারক রয়েছে তাদের মন্ত্রণালয়গুলোর সব করিডর জানা আছে, তাই প্রয়োজনে তারা নির্দিষ্ট কর্মকর্তার কাছে গিয়ে স্বাক্ষর এবং স্ট্যাম্পের মাধ্যমে শ্রমিক আনার নামে ভিসা বাণিজ্যের অবাধ ক্ষেত্র তৈরি করেছে।
তবে এর সমাধান খুব সহজেই করা যায়। প্রথম ধাপে আমাদের স্পন্সরশিপ ব্যবস্থা বাতিল করা জরুরি। এরপর যে কোন প্রতিষ্ঠানের জন্য নিয়োগ পাওয়া ব্যাক্তিকে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অফিসিয়াল কোন ওয়েবসাইটে ঘোষণা দিয়ে নেয়ার শর্ত থাকতে হবে। যেখানে নিয়োগ দেয়া প্রতিষ্ঠান ও সরকারের মধ্যে একটি যোগসূত্র তৈরি করে নিয়োগ প্রক্রিয়াকে আরো স্বচ্ছ করা যায়। কর্মী আনা হলে কোনো স্পনসরশিপ ছাড়াই আনার শর্ত থাকবে এব এক্ষেত্রে সংযুক্তি হিসিবে থাকবে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাজের চুক্তি।
চুক্তিটিতে লেখা থাকবে চাকরির ধরণ, বাসস্থান ব্যবস্থা, বাসস্থানের দায়িত্ব কারা নিবে। এখানে চুক্তির সব ধারাতে সকলের অধিকার রক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। কোন কর্মী কেবলমাত্র কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ না হয়ে বরং একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির (সরকার, নিয়োগকর্তা এবং কর্মচারী) ভিত্তিতে এই দেশের কর্মসংস্থান প্রক্রিয়ায় যুক্ত হবেন। তার চাকরির মেয়াদ শেষ হলে তিনি সাথে সাথে বিমানবন্দর দিয়ে নিজ দেশে ফিরে যাবেন, যাতে যেমন মর্যাদা নিয়ে তিনি এসেছেন তেমন মর্যাদা নিয়ে ফিরে যেতে পারেন।
সবারই এটা বুঝা উচিত যে শ্রমিকরা এখানে অভিবাসন বা চিরস্থায়ী বসবাসের জন্য আসে না বরং তারা আসেন কাজ করে কিছু অর্থ উপার্জন করতে। কুয়েত এমন একটি দেশ যেটি সর্বদা তার অতিথিদের স্বাগত জানায় যারা আইন লঙ্ঘন করেন না এবং দেশের নীতিকে সম্মান জানিয়ে উন্নয়নে অবদান রাখেন।
আমাদের নতুন যুগের জন্য মানানসই নতুন কর্মসংস্থানের দিকে পা বাড়ানো জরুরি। আমাদের শ্রমবাজারের প্রকৃত চাহিদা অনুযায়ী আমাদের কর্মসংস্থানকে সাজানোর সময় এখনি। এক্ষেত্রে আমাদের কার্যকর শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আমাদের মৌলিক পরিস্থিতি তৈরি করে কাজের বাস্তবায়ন ঘটানোর জন্য আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এবং এ কাজের সহযোগিদের প্রশংসা পত্র পাঠিয়ে স্বীকৃতি দেওয়াটা অনেক প্রয়োজনীয় হতে পারে। তবে এখানে এখন ফাঁকা প্রশংসায় কাউকে ভাসানোর চাইতে জনস্বার্থকে গুরুত্ব দিতে হবে।
একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে আছে যা মোটেই উপেক্ষা করা উচিত নয়, সেটি হল ভিসা বাণিজ্যে প্রবাসীদের জড়িত থাকা। একথা সকলেরই কমবেশি জানা যে এসব প্রবাসী ভিসা ব্যবসায়ীরা কুয়েতের পৃষ্ঠপোষকদের রাজি করিয়ে বিদেশি শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব করে তাদের প্রতারণার জালে ফেলে। এখানে এসব স্পন্সর বা পৃষ্ঠপোষকরা কর্মীদের থেকে নেয়া অর্থের ভাগ পেয়ে থাকেন। বিভিন্ন সূত্র বলছে, কিছু প্রতিনিধি এক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে ভিসা বাণিজ্য পরিচালনা করেন এবং বিষয়টি শ্রমিকদের অনেকের জানা থাকার পরও তারা অবৈধ উপায়ে এখানে আসতে এমন দুর্নীতিগ্রস্ত এজেন্ট বা প্রতিনিধি খুঁজে নেন।
যে কর্মী এই প্রক্রিয়ার খপ্পড়ে পড়ে যান তিনি মনে করেন ভবিষ্যতের জন্য আপাতত কিছু ত্যাগ করা যেতেই পারে। এক্ষেত্রে তাদেরকে সঠিক জ্ঞান দেয়ার মত কেউ থাকে না যে তাঁরা রেসিডেন্সি আইন ভঙ্গ করার দলে নাম লেখাচ্ছেন । দুর্ভাগ্যবশত, পরিস্থিতি তাদের এসব ধারণাকে সমর্থন জোগায় করে এবং তাদের অনেকের মনে হয় তারা সঠিক কাজটিই করছেন!
তাই স্বাভাবিকভাবে, আমি তাদের ভালবাসি যারা নিজেদের উন্নতি এবং মূল্য বাড়ানোর চেষ্টা করে এবং উন্নত জীবনকে আরো সুন্দর করার পথ তৈরি করে। এটাই হওয়া উচিত মানুষের প্রয়োজন মেটানোর বৈধ কোন উপায়। কিন্তু যারা নিয়ম না মেনে এসব করছেন তারা দেশের নীতি ও আইনের লঙ্ঘন করছেন। এখানে যেসব পক্ষ জড়িয়ে পড়ে তারা হল:
১. আইন সম্পর্কে অজ্ঞ কোন কর্মী
২. প্রতারক প্রতিনিধি (মান্দব)
৩. লোভী স্পনসর বা পৃষ্ঠপোষক
আমাদের নতুন করে শত্রু না বাড়িয়ে এই শ্রেণিবিভাগকে মাথায় রেখে এর মানবিক বিষয়গুলো বিবেচনায় আনতে হবে। এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় আমাদের জন্য জরুরি। বিষয়টি হল আমাদের কর্মসংস্থানে যোগ্য শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত, যারা দেশের শিল্পের চাকাকে আরো উন্নত পর্যায়ে নিতে ভূমিকা রাখবে।
যদিও উপরে যাদের কথা বল তাদের মধ্যে সবাই সংবিধান ও আইনের শাসন লঙ্ঘন করেন না। এদের মধ্যে অনেক সম্মাননীয় লোক আছেন। সমাজে তাদের স্বীকৃতি পাওয়া দরকার যেহেতু তারা সর্বোচ্চ শ্রেণী গঠন করেন। এদের মধ্যে রয়েছেন ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষক, উচ্চতর ডিগ্রী ধারক, কারিগর, এবং অন্য পেশার যারা দেশের উন্নয়নে সেবা প্রদান করে থাকেন।
কুয়েতে অনেক স্পনসর আছেন যারা পেশাগতভাবে সবকিছু সামাল দেন এবং তাদের অধীনে নিবন্ধিত শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি ও বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখেন। অবশ্যই তারা স্পন্সরদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট। যাইহোক, আমার লেখায় খারাপের উদাহরণ বেশি উঠে এসেছে যেহেতু বর্তমানে “তুষার-শুভ্র পরিস্থিতি” ঢাকা পড়েছে ধুলার আবরণে।
আগের খবর
কুয়েতে ভিসা বাণিজ্যের বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছে সুশীল সমাজ
কুয়েতে ভিসা বাণিজ্যে ও মানবপাচার চক্রের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা!
কুয়েতে প্রবাসী অংশীদারসহ ২৮ ভিসা ব্যবসায়ীকে আটকের নির্দেশ
কুয়েতে ভিসা বাণিজ্যে, ৫০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা