কুয়েতে ভিসা বাণিজ্যে ও মানবপাচার চক্রের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা!
অবৈধ ভিসা বাণিজ্যে ও মানবপাচারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে গেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েত। এ নিয়ে কুয়েত সরকার আগের যে কোন সময়ের চেয়ে শক্ত অবস্থানে থেকে এর সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় আনছে, নিচ্ছে নানা অভূতপূর্ব ব্যবস্থা, যখন দেশটি ২০০৮ সাল থেকে এই সমস্যা সমাধানের পথ খুজছেন এবং অনেকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
মানবপাচারের নেতিবাচক প্রভাবে দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন ছিল কুয়েত সরকার। তবে করোনাভাইরাসের প্রকোপের পর দেশটিতে এ অবৈধ বাণিজ্যের সংকট আরো নেতিবাচক প্রভাব ফেলায় সরকার সত্যিকার অর্থেই কঠোর অবস্থানে।
অনেকেরই মতে বিগত কয়েক দশকে ভিসা বাণিজ্যে ও মানবপাচার অপরাধের কারণে জনসংখ্যার মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য বিনষ্ট হয়েছে। যে কারণে এখন একদিকে যেমন কোভিড-১৯ মহামারির বিস্তার ঠেকাতে সরকারকে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তেমনি এতে শ্রমবাজারে বেশ কিছু সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা তৈরি হয়েছে।
আরব টাইমস পত্রিকার এক সাম্প্রতিক সংবাদে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে বলা হয়েছে, মানবপাচারের বিরুদ্ধে লড়াই এখন আর বিলাসিতা নয়। এর সাথে দেশটির ভেতরে এবং বাইরে যারাই জড়িত আছে তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে কুয়েত।
মূলতঃ করোনা পরিস্থিতিতে সাধারণ ক্ষমা দিয়ে দেশটিতে অবৈধ অভিবাসীদের দেশত্যাগের সুযোগ দিতে গিয়ে ওঠে আসে ভিসা বাণিজ্যের বিষয়টি। বেরিয়ে আসে ভেতরের অনেক রহস্য-চিত্র-তথ্য আর রাঘব বোয়ালদের সম্পৃক্ততা।
মানবপাচার ও ভিসা বাণিজ্য বিরুদ্ধে যুদ্ধের মূল নায়ক কুয়েতের বর্তমান প্রদানমন্ত্রী শেখ সাবাহ আল-খালেদ আর তা মাঠে পর্যায়ে বাস্তবায়ন করেছেন দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আনাস আল-সালেহ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ সাবাহ আল-খালেদ মানবপাচার এবং ভিসা বাণিজ্য অপরাধ মোকাবিলা করাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়েছেন এবং তিনি সন্দেহভাজন কোম্পানি ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত করার জন্য একটি প্রক্রিয়া চালু করেছেন। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ভিসা বাণিজ্য ও মানবপাচারের সাথে জড়িত আছে সন্দেহে প্রাক্তন সাংসদ-মন্ত্রী ও ব্যবসায়ীদের নামের একটি বিশেষ তালিকা সরকারের হাতে এসেছে।
উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র মতে, এই ধাক্কায় এমন অপরাধের অবসান ঘটাতে দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আনাস আল-সালেহ সরকারের কাছ থেকে ওপেন ম্যান্ডেট নিয়েছেন। এরই মধ্যে মানব পাচারকারীদের নির্মূল করতে এবং এ ব্যবসায় ব্যবহৃত তহবিলের সন্ধানে তার নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী দল গঠন করা হয়েছে। এতে জনশক্তি,স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিচার মন্ত্রণালয়, ফতোয়া এবং আইনি পরামর্শ বিভাগ এবং সাধারণ তদন্ত বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রয়েছেন। দলটি পাচারকারীদের বিরুদ্ধে সমস্ত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি এই অবৈধ কাজের জন্য ব্যবহৃত তহবিলেরও সন্ধান করবে।
শুরুতেই যখন কর্ণেল পদ মর্যাদার একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে তার ৫ মিশরীয় অংশীদারসহ অভিযুক্ত করা হয়, তাতেই সরকারের অবস্থান স্পষ্ট হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে ভিসা বাণিজ্যে ও মানবপাচারের অভিযোগে ৫০ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে। যার মধ্যে কুয়েতের পাবলিক প্রসিকিউশন মামলায় জড়িত ২৮ জন নাগরিককে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশ থেকে জনপ্রতি অর্থের বিনিময়ে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক আনা এবং ভিসা প্রদান বা কোনও চাকরি না দিয়ে রেসিডেন্ট পারমিট নবায়নসহ ভিসা বাণিজ্যে ও মানব পাচারে অভিযোগ আনা হয়েছে।
কুয়েতের সংবাদপত্র কুয়েত টাইমসের এক প্রতিবেদন বলা হয়েছে,পাবলিক অথরিটি ফর ম্যানপাওয়ার গঠিত হওয়ার পর থেকে দেশে রেসিডেন্স আইন ভঙ্গকারি বিশেষ করে কিছু মিশরিয় এবং বাংলাদেশিদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। বিষয়টি আগে সমাজ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকলেও নতুন কর্তৃপক্ষের বেশ কিছু উচ্চ পদস্থদের মাধ্যমে এখানে জনশক্তির নামে মানবপাচার হয়েছে বলে অভিযোগ উঠে এসেছে।
একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাতে পত্রিকাটি জানায়, অভিবাসন তদন্ত কর্তৃপক্ষের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক কর্নেল শেখ আবদুল্লাহ আল-মালিককে, এই মানবপাচার-কাণ্ডের সাথে জড়িত আছে এমন সন্দেহভাজনদের কোন ধরনের সহায়তা না করতে সরকার নির্দেশ দিয়েছে। এর পাশাপাশি এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে সরকার ব্যাপক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন অনেক কর্মকর্তা ও ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছে।
এই সূত্রটি আরো জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মানব পাচার রোধে একটি নতুন প্রক্রিয়া ধরে এগুচ্ছে। যারা প্রবাসীদের অবৈধ প্রবেশে সুবিধা প্রদান করেছে বলে কথা উঠেছে তাদের উপর বিশেষ নজর রাখা হয়েছে। তাছাড়া সাধারণ ক্ষমায় আত্মসমর্পন করে ক্যাম্প থাকা বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের অবৈধ প্রবাসীদের কাছে ঝটিকা সফরে গিয়ে সরকারি কর্মকর্তারা জানার চেষ্টা করছে কারা তাদের কত টাকার বিনিয়মে কিভাবে এই দেশে এনেছে। এক্ষেত্রে যারা জড়িত আছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে তাদের উপর রেসিডেন্স আইনের লঙ্ঘনকারীদের এখনকার বাসস্থান খরচ, দেশে যাওয়ার টিকেট খরচ বহনের পাশপাশি অর্থ জরিমানারও দায় চাপানো হচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, এক্ষেত্রে ৫০ জনের অধিক শ্রমিক নিয়োগ দেয়া কোম্পানিগুলোর রেকর্ড যাচাই বাছাই করছে। এর মধ্যে নিশ্চিত হওয়া গেছে গাড়ি মেরামতের গ্যারাজ হোক বা ছোট কারখানা, মোবাইল দোকান, মুদিদোকানের পাশাপাশি হেলথ ক্লাব, মহিলা ও পুরুষদের বিউটি পার্লার, খামার, ফিশিং ব্যবসা, ট্যাক্সি সার্ভিস এসবের বেশিরভাগই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের কিছু সিনিয়র কর্মকর্তার মালিকানাধীন।
শুধু কুয়েতি নয়, তাদের প্রবাসী আংশীদারদেরও আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ীও রয়েছেন বলে কুয়েত থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে।
আগের খবর
কুয়েতে প্রবাসী অংশীদারসহ ২৮ ভিসা ব্যবসায়ীকে আটকের নির্দেশ
কুয়েতে ভিসা বাণিজ্যে, ৫০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা
কুয়েতে মানবপাচারে অভিযুক্ত শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা!