কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাসে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ উদযাপন

বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ স্বাধীনতার মহাকাব্য : তোফায়েল আহমেদ

কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাসের উদ্যোগে যথাযোগ্য মর্যাদায় ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ উদযাপন করা হয়েছে। রোববার সকালে বাংলাদেশ দূতাবাস ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে দিবসের কর্মসূচির সূচনা করেন কুয়েতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশিকুজ্জামান। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণের মধ্য দিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। জাতির জনক ও তার পরিবারসহ শহীদদের জন্য দোয়া মোনাজাত করা হয়। এসময় দূতাবাসের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্যায়ের দিবস উপলক্ষে ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং সাবেক শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এমপি।

রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশিকুজ্জামানের উপস্থাপনায় ভার্চুয়াল আলোচনায় বিশেষ অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। বিশেষ বক্তা ছিলেন কাতারে নিযুক্ত ইউনেস্কোর উপসাগরীয় আঞ্চলিক পরিচালক পরিচালক আনা পারলিনী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবু মোহাম্মদ দোলোয়ার হোসেন।

Travelion – Mobile

এছাড়া দূতাবাসের ডিফেন্স অ্যাটাচি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু নামের, শ্রম কাউন্সেলর মোহাম্মদ আবুল হোসেন, কাউন্সেলর পাসপোর্ট ও ভিসা সচিব মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম, কাউন্সেলর ও দূতালয় প্রধান নিয়াজ মোর্শেদ, কুয়েতে প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব ও সংগঠন নেতা আবদুল রব মাওলা, রফিকুল ইসলাম ভুলু, আতাউল গণি মামুন, ডা. এস এম মনিরুজ্জামান, আকবর হোসেন, কামাল হোসেন, আবদুল হাই ভূঁইয়া, ইমাম উদ্দিন বাদল, নজরুল ইসলাম শাহীন, তোফাজ্জেল হোসেন, নাসিরউদ্দিন খোকন, মৃনাল কান্তি রায় নেতাকর্মী ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতারা আলােচনায় যুক্ত হয়ে বক্তব্য রাখেন।

আলোচনায় একাত্তরে ৭ ই মার্চের স্মৃতিচারণ করে বঙ্গবন্ধুর স্নেহধণ্য ও একান্ত সানিধ্যে পাওয়া বর্ষীয়ান রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদ বলেন, “সে দিন ১০ লক্ষাধিক জনতার গগনবিদারী স্লোগানে মুখরিত রেসকোর্স ময়দান। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দেওয়ার জন্য দাঁড়ালেন, চারদিকে তাকালেন। মাউথপিসের সামনে পোডিয়ামের ওপর চশমাটি রাখলেন, বাংলার মানুষকে ডাক দিলেন, ‘ভাইয়েরা আমার’। তারপর একটানা ১৯ মিনিট ধরে বলে গেলেন দুনিয়া কাঁপানো মহাকাব্য। বক্তৃতায় তিনি মূলত স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। বঙ্গবন্ধুর সামনে ছিল দুটি পথ। এক. স্বাধীনতা ঘোষণা করা। দুই. পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব না নিয়ে, বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত না হয়ে, সুচিন্তিত বক্তব্য প্রদান করা। তিনি দুটিই করলেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন সেদিনের পরিস্থিতি। সেনাবাহিনী তখন প্রস্তুত। মাথার ওপর বোমারু বিমান ও হেলিকপ্টার গানশিপ টহল দিচ্ছে। যখনই বঙ্গবন্ধু এই ভাষায় বলবেন যে আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন, তখনই তারা গোলাবর্ষণ শুরু করবে। সে জন্য বঙ্গবন্ধু সব কিছু জেনেই বক্তৃতা করেছেন। অনেকেই তো বঙ্গবন্ধুকে বলতে চেয়েছেন, আজকেই যেন বলেন, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কারো দ্বারা প্ররোচিত হননি। এত বিচক্ষণ নেতা ছিলেন যে সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে সামরিক শাসকের উদ্দেশে চারটি শর্ত আরোপ করলেন-মার্শাল ল’ প্রত্যাহার করো, সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নাও, এ কয়দিনে যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করো এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করো। এই চারটি শর্ত আরোপ করে তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায়িত হলেন না, পাকিস্তানিরা তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত করার চেষ্টা করেছিল। অন্যদিকে পুরো বক্তৃতাটি জুড়ে ছিল আসন্ন জনযুদ্ধের রণকৌশল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা।”

তিনি বলেন, আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের বক্তৃতা বিশ্লেষণ করি তবে দেখবো, অলিখিত একটি বক্তৃতা। ভাষণের সময় ১৯ মিনিট। শব্দ সংখ্যা ১৩০৮টি। আব্রাহাম লিংকনের Gettysburg Address-এর শব্দ সংখ্যা ২৭২, সময় ৩ মিনিটের কম এবং লিখিত। অপরদিকে, মার্টিন লুথার কিং-এর ‘‘I have a dream’’ ভাষণটির সময় ১৭ মিনিট, শব্দ সংখ্যা ১৬৬৭। কিন্তু বিশ্বের কোনো নেতার ভাষণ এমন সংগ্রামমুখর ১০ লক্ষাধিক মুক্তিকামী নিরস্ত্র মানুষের সামনে হয়নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণটি প্রদান করে মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে, নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করে মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিলেন। কী বিচক্ষণ একজন নেতা! একটি বক্তৃতার মধ্য দিয়ে তিনি একটি জাতি-রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন। একটি বক্তৃতার মধ্য দিয়ে তিনি নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র বাঙালি জাতিতে রূপান্তরিত করেছেন। এই একটি বক্তৃতার মধ্য দিয়ে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে তিনি স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে একই মোহনায় দাঁড় করিয়েছেন। ৭ই মার্চের বক্তৃতার দিকনির্দেশনা অনুযায়ী নয় মাস জনযুদ্ধ ও গেরিলাযুদ্ধের পথ অনুসরণ করে ৩০ লক্ষাধিক প্রাণ আর ৪ লক্ষাধিক মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা মহত্তর বিজয় অর্জন করেছি। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ আমাদের জাতীয় চেতনার ভিত্তি হয়ে আজ পবিত্র সংবিধানের অংশ।

ঐতিহাসিক ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর  প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করছেন কুয়েতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশিকুজ্জামান
ঐতিহাসিক ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করছেন কুয়েতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশিকুজ্জামান

একাত্তরে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে নিজের উপস্থিতির কথা স্মরণ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ কেবল নিপীড়িত বাঙালি জাতির স্বাধীনতার সংগ্রামের গল্পই বলে না, ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হয়ে, অবশেষে এটি বিশ্বজুড়ে সমস্ত নিপীড়িত এবং স্বাধীনতা-প্রেমী মানুষের জন্য চিরস্থায়ী অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে; তাদের জন্মভূমি যেখানেই হোক না কেন, তারা যে ভাষাতেই কথা বলুক না কেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব ঐতিহ্যের এক অনন্য সম্পদ উল্লেখ করে ইউনেস্কোর পরিচালক বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিতে একটি স্বাধীন দেশের ঘোষণা যেমন ছিল সেই সাথে ছিল উপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলো যেভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক ও জাতিগত ভাবে একটি জনগোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্ন করে তোলে তার বিরুদ্ধে একটি সাহসী উচ্চারণ। সম্পদ ও উপযুক্ত সমরাস্ত্র বিহীন একটি ছোট দেশের শুধুমাত্র সহায় সম্বলহীন মানুষের শক্তিকে ভিত্তি করে স্বাধীনতার স্বপ্নকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া ও তাকে বাস্তবায়িত করার ঘটনা বিশ্বে বিরল। যা হয়ত একজন মহান নেতৃত্বের কারনেই সম্ভব হয়েছিল। এই ভাষণকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে ইউনেস্কো গর্বিত।

প্রধান বক্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবু মোহাম্মদ দোলোয়ার হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই মোহ জাগানিয়া রক্তে আগুন ধরানো ভাষণ রেসকোর্স থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত নিমেষেই পৌঁছে গিয়েছিল বাংলার প্রতিটি প্রান্তে, প্রতিটি ঘরে। তাঁর সেই উদ্দাত্ত আহ্বান “যার যা কিছু আছে তা ই নিয়ে ঝাপিয়ে পর অথবা প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল” সেদিন প্রতিটি বাঙালির প্রানের কথা হয়ে ধ্বনিত হয়েছিল বাংলার আকাশে বাতাসে। “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম” উদ্ভুদ্দ করেছিল বাংলার প্রতিটি মানুষকে। এই ভাষণের মন্ত্রে একটি নিরস্ত্র জাতি পরিনত হয়েছিল সশস্ত্র জাতিতে।”

আরও পড়তে পারেন :
আইরিশ, স্কটিশ, ওয়েলশ ভাষায় প্রকাশ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ
দিবসই প্রমাণ করে নারী এখনো সমতায় পৌঁছেনি
কূটনীতিতে নারীর জ্যোতি
করোনাকালের একজন মানবিক রাষ্ট্রদূতের গল্প
‘আমার কাছে প্রতিদিনই নারী দিবস’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!