কর্মীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে কাতার এয়ারওয়েজ!
জনসংযোগের গোমর ফাঁস
কাতার এয়ারওয়েজ। বিশ্বের প্রথম সারির বিমানসংস্থা। এভিয়েশন রাঙ্কিং সাইট স্কাইট্রাক্স জরিপে আছে ফাইভ-স্টার এয়ারলাইন্সের তকমা, মুকুটে আছে অনেক শিরোপা। তবুও নিজেদের জনসংযোগে নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে এভিয়েশন খাতকে বেশ অবাকই করেছে কাতারের পতাকাবাহী এই বিমানসংস্থা।
সম্প্রতি কাতার এয়ারওয়েজের জনসংযোগ কৌশল নিয়ে বেশ সমালোচনা চলছে সংশ্লিষ্ট নানা মহলে। মধ্যপ্রাচ্যের বিখ্যাত সংবাদমাধ্যম আরব নিউজের এক প্রতিবেদনেও ওঠে এসেছে বিমান সংস্থাটির ভেতরকার নানা কথা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যে সময়ে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি বিমানসংস্থা ভ্রমণের খরা আর আর্থিক মন্দায় পড়ে ঘুর পথে গিয়েছে তখন কাতারের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই সংস্থার নিজেদের কার্যক্রম চালু রাখা নিয়ে ভাবনার অবকাশ ছিল। অথচ সে পথে না গিয়ে তারা এমন কৌশল বেছে নেয় যেখানে তাদের কার্যক্রম চালু রাখাকে মহত্ত্ব দেয়ার পাশপাশি কর্মীদের কাজে নামাতে চলে কর্পোরেট হুমকি-ধামকি।
এমনিতেই বিদেশী শ্রমিকদের নিপীড়ন নিয়ে কাতারের একটি নেতিবাচক ইমেজ আছে সারা বিশ্বে। তার উপর ফ্লাইট কার্যক্রম চালু রেখে মিডিয়ার দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর প্রচেষ্টা জন্ম দিয়েছে নানা সমালোচনার।
এক লাখ চিকিৎসক এবং নার্সদের বিনামূল্যে টিকেট দেয়ার বিষয়টি ধরা যাক। খালি চোখে এটি স্বাস্থ্য খাতের পেশাজীবী যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনা মহামারিতে মহৎ ভূমিকা রেখেছেন তাদেরকে সাধুবাদ জানানোর একটি প্রশংসনীয় প্রয়াস। তবে দেখার বিষয় হল এমন এক সময়ে তারা এই ঘোষণা দিয়েছে যখন সারা বিশ্বজুড়ে সংস্থাগুলো তাদের কার্যক্রম নিয়ে শংকায় আছে, যখন এয়ারপোর্টগুলো বন্ধ আছে এবং যাত্রী-চলাচল সম্পূর্ণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অথচ কাতার এয়ারওয়েজের এই ফ্রি-টিকেট স্কিম, মহামারিতে কর্মীদের বেতন কাটার বিষয়টি থেকে মিডিয়ার মনোযোগ সরানোর একটি প্রচেষ্টা সেই দুরভিসন্ধি কেবল এর সমালোচকরাই টের পাননি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গেল মার্চে অন্য প্রতিযোগী সংস্থা যখন তাদের ফ্লাইট পিছিয়েছে তখন কাতার এয়ারওয়েজ তাদের ফ্লাইটগুলোতে যাত্রীদের জন্য অতিরিক্ত আসনগুলোও বুক করেছে। বিভিন্ন দেশে আটকেপড়া মানুষদের নিজ দেশে প্রিয়জনের কাছে ফিরিয়ে নিতে এই কার্যক্রম চালিয়েছে কাতার এয়ারওয়েজ
নিজেদের জনসংযোগের জন্য বেশ বড় একটি ইতিবাচক ফলাফল এনেছে। এসব মিডিয়া গেমের মাধ্যমে বিমানসংস্থাটি কর্মী ছাটাই ও বেতন কেটে নেয়ার মত শ্রম অধিকার হরণকে ধামাচাপা দিতে পেরেছে বলা যায়।
সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশের ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরব নিউজকে বলেন “আমাদের কোনো উপায় ছিল না। এই সব ফ্লাইটে কাজ করতে আমাদের চাকরি থেকে ছাটাইয়ের হুমকি দেয়া হত। তাই আমরা কাজে আসতে বাধ্য হয়েছি। কখনো কখনো ম্যানেজার আমাদের হুমকি দিতেন নানা আপত্তিকর ভাষা ব্যবহার করে। যেমন এই ফ্লাইট নাও কিংবা তোমার তৃতীয়-বিশ্বের দেশে ফিরে যাও। ”
এই কর্মী আরো বলেন, “যেসব কর্মী কর্মকর্তাদের প্রিয় বিশেষ করে ইউরোপীয়ান যারা তাদের বলা হয়েছিল সিএনএন-এর একটি প্রতিবেদনের জন্য কিছু সাজানো কথা তুলে ধরতে। যেমন, স্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য ফ্লাইট চালাতে পেরে আমরা খুব খুশি। এ কাজের জন্য তাদের অনেক মোটা অংকের অর্থ দেয়া হয়েছিল যদিও তাদের ক্ষেত্রে ফ্লাইটে যোগ দেয়ার বিষয়টি নিয়ে কোন জোরাজোরি ছিলনা কর্মকর্তাদের। অথচ বাকী সব কেবিন ক্রুদের কেবল হুমকি দিয়েই কাজে আনা হত।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দোহাকে বিশ্বের অন্যতম একটি বাণিজ্যিক ও আন্তর্জাতিক ভ্রমণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত করলেও ছাটাই হওয়া ও বাধ্য হওয়া কর্মীদের এসব দুঃখজনক ঘটনার কারণে কাতার এয়ারওয়েজের উপর নেতিবাচক ছায়া পড়েছে।
কাতার এয়ারওয়েজ গ্রুপের আওতাভুক্ত এই বিমানসংস্থাটিতে ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত তথ্যে কর্মরত ছিল ৪৬ হাজার ৬৮৪ জন কর্মী। যদিও এর সিইও আকবর আল-বেকার স্বীকার করেছেন কাতার এয়ারওয়েজ তার প্রায় ২০ শতাংশ জনবল কমিয়ে আনবে। তাদেরকে চাকরিচ্যূত করা নিয়ে সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমাদের জন্য তাদের যেতে দেওয়া সত্যিই বেদনাদায়ক, কিন্তু আমাদের অন্য কোনো পথ নেই।” যদিও “সত্যিই বেদনাদায়ক” হলে মাস শেষে ওইসব কর্মীর বেতন কর্তনের কষ্ট তাদের অনুভূতিকেও নাড়া দিত।
অসমর্থিত সূত্রে জানা গেছে, কাতার এয়ারওয়েজ তাদের ৫০০০ কেবিন ক্রুকে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছে। তবে কাদের ছাটাই করা হবে সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া না গেলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা আলোচনার সূত্রে জানা গেছে যারা ১৫ বছরেরও বেশি সময় সেবা দিয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এটি প্রমাণ করে যে বয়সভিত্তিক নিয়োগ-ছাটাইয়ের ছকে বাঁধা পড়ে গেছে কাতার এয়ার।
মজার বিষয় হচ্ছে, অনেক বিমান সংস্থা যখন জুনের মাঝামাঝি সময় থেকে আংশিকভাবে তাদের সেবা শুরুর পরিকল্পনা করছে, সতর্কতামূলক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কথা জানাচ্ছে তখন কাতার এয়ারওয়েজ তাদের করোভাইরাস যুগের ব্যবসায়িক মডেল নিয়ে গুঞ্জন তুলতে ব্যস্ত। এর মধ্যে তারা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী পরিহিত কর্মীদের অন-বোর্ড ছবি মিডিয়ায় প্রকাশ করে জানিয়েছে যে ২৫ মে থেকে তারা ফ্লাইটে এসব ব্যবহার করবে। নতুন নিরাপত্তা সতর্কতার অংশ হিসেবে তারা বলছে, যাত্রী ও ক্রুদের মধ্যে সংস্পর্শ কমিয়ে আনতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
আরব নিউজের প্রচেষ্টা থাকার পরও এ ব্যাপারে কাতার এয়ারওয়েজের কাছ থেকে কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে, সংস্থাটি একটি বিষয়ে নিশ্চিত থাকতে পারে তা হল কাতার সরকার থেকে তাদের কোন বিপদে পড়ার আশংকা নেই।
তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় এটা অন্যায় হবে যদি অব্যবস্থাপনার জন্য কেবল কাতার এয়ারওয়েজকে আলাদা করে দায় করা হয়। কারণ ছোট এই দেশটিতে এর মধ্যে প্রায় ৫৩ হাজার করোনা আক্রান্ত হয়েছে যেখানে এর জনসংখা মোটে ২৭ লাখ। আক্রান্তের সংখ্যায় উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে কাতার এখন দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।