করোনায় বিপর্যস্ত এভিয়েশন ও পর্যটন
চীনে প্রাণঘাতী কেভিড-১৯-করোনাভাইরাসের কারণে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে এশিয়াসহ বিশ্ব এভিশেয়নশিল্প। ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) তথ্য মতে, কোভিড ১৯ এর প্রভাবে বিশ্বের বিমান সংস্থাগুলোকে ৫ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত লোকসানের মাসুল গুণতে হতে পারে। ৭০টি এয়ারলাইনস চীন থেকে সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল করেছে এবং আরো ৫০টি এয়ারলাইনস সম্পর্কিত বিমান পরিচালনা বন্ধ করেছে। ফলে সরাসরি চীন থেকে আসা বিদেশিদের জন্য বিদেশি বিমান সংস্থার সক্ষমতা ৮০ শতাংশ কমেছে এবং চীনা এয়ারলাইনসের ধারণক্ষমতা কমেছে ৪০ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদ মতে, করোনাভাইরাসে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে বিশ্ব অর্থনীতিকে যে বড় ধরনের মন্দার মধ্য দিয়ে যেতে হবে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। তবে যেই অঞ্চল থেকে এই প্রাদুর্ভাবের শুরু সেই অঞ্চল হল এশিয়া। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার প্রভাবে সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে এশিয়ার অর্থনীতি। আর সেই তালিকায় প্রথমেই চলে এসেছে এভিয়েশন খাত ।
এভিয়েশনের সাথে পর্যটন খাতেও করোনাভাইরাস জেরে ধস নেমেছে বিশ্বজুড়ে । এশিয়ার অন্যতম দেশ বাংলাদেশেও এই দুই খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
আকাশপথে ঢাকা ও চীনে যাত্রী ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় ফ্লাইট অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে বিমান সংস্থাগুলো। শুধু চীন নয়, অন্যান্য গন্তব্যেও এর প্রভাব পড়ছে। ভাইরাস আতঙ্কে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ এশিয়ার প্রধান পর্যটন গন্তব্যগুলোতে টিকিট বাতিল করেছে প্রায় ৮০ শতাংশ বাংলাদেশি ভ্রমণকারী।
একইভাবে বাংলাদেশে আসার পূর্বনির্ধারিত ভ্রমণও বাতিল করছে অনেক বিদেশি পর্যটক। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছে এয়ারলাইনস ও পর্যটন প্রতিষ্ঠানগুলো। তাই পর্যটক আকর্ষণের জন্য বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে নিয়মিত ব্রিফ করার পরামর্শ দিয়েছেন এ খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, বাংলাদেশ যে এখনো করোনাভাইরাসমুক্ত, তা বহির্বিশ্বে তুলে ধরা প্রয়োজন।
করোনা আতঙ্কে বাংলাদেশিরা বাইরে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে বিশেষ করে সংক্রামক দেশগুলোতে পূর্বনির্ধারিত টিকিট বাতিল করছে বলে জানিয়েছেন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) ।
আটাব সভাপতি মনছুর আহমদ কালাম বলেন,‘ভরা পর্যটন মওসুমে এমন প্রতিকূল পরিস্থিতির কথা আমরা কখন কল্পনাও করতে পারিনি। টিকিটের ৮০ শতাংশই বাতিল হচ্ছে, যাত্রীরা রিফান্ড (টাকা ফেরত) নিচ্ছেন। চীনের গন্তব্যগুলোতেই শুধু খারাপ অবস্থা নয়, অন্যান্য দেশেও এই প্রভাব পড়ছে। এত নেতিববাচক প্রভাব পড়বে তা আমাদের হিসেবের বাইরে ছিল।’
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি মো. রাফেউজ্জামান বলেন, ‘আউটবাউন্ড ও ইনবাউন্ড পর্যটনের একটি বড় বাজার চীন। করোনাভাইরাসের কারণে উভয় পর্যটনেই বড় ধাক্কা লেগেছে। এর ওপর আবার সিঙ্গাপুর, চীন, থাইল্যান্ড, জাপানসহ আরো কিছু গন্তব্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আমাদের ট্যুর অপারেটররা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চীনের প্রায় সব ভ্রমণ প্যাকেজ বাতিল হচ্ছে।’
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ এইচ এম তৌহিদ-উল-আহসান বলেন, ‘বিমানবন্দরে ভাইরাস শনাক্তকরণ কার্যক্রম সঠিকভাবে মেনে চলার জন্য আমরা তত্পর আছি। যাত্রী কমে যাওয়ায় চীন থেকে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনাকারী এয়ারলাইনসগুলো গত সপ্তাহ থেকে ফ্লাইট অর্ধেকের বেশি কমিয়ে এনেছে। এ ছাড়া ঢাকা-সিঙ্গাপুর রুটেও ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সি কমাচ্ছে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস।’
ফ্লাইটের বুকিং বাতিল করা ছাড়াও টিকিট কনফার্ম (নিশ্চিত) থাকা সত্ত্বেও যাত্রী বিমানবন্দরে উপস্থিত না হওয়ার (নো শো) হার বাড়ছে। বিমানবন্দরে দায়িত্বরত চায়না সাউদার্নের কর্মকর্তা জানান, ‘গুয়াংজুগামী ফ্লাইটে কনফার্মেশন কমছেই। নো শো হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।’
চীন থেকে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস, চায়না ইস্টার্ন ও চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইনসে প্রতিদিন ছয়টি ফ্লাইটে বাংলাদেশে ঢুকছে ৭০০ যাত্রী।
গুয়াংজুতে চলাচলকারী বাংলাদেশের একমাত্র বিমানসংস্থা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কামরুল ইসলাম বলেন,‘গত ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে আমরা ঢাকা-গুয়াংজু ফ্লাইটের সংখ্যা কমিয়েছি। আগে সাতটি ফ্লাইট চললেও এখন তিনটি চলছে; যদিও এই তিনটি ফ্লাইটে চীনগামী যাত্রী কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ। তবে ফিরতি ফ্লাইটে যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে।’
পর্যটন, ব্যবসা ও চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশিদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান সিঙ্গাপুর। সেখানকার পর্যটন এলাকাগুলো এখন জনশূন্য, রাস্তাঘাটও ফাঁকা। যাত্রী আগমন ও সেবা বিবেচনায় একাধিকবার বিশ্বে শীর্ষস্থান পেয়েছে সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দর। কিন্তু করোনাভাইরাস আতঙ্কে এরই মধ্যে যাত্রী হারাতে শুরু করেছে বিমানবন্দরটি।
পর্যটন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ভাইরাস আতঙ্কে এরই মধ্যে সিঙ্গাপুরের সব ভ্রমণের বুকিং বাতিল করেছে পর্যটকরা। এতে সিঙ্গাপুর যেমন ক্ষতির মুখে পড়েছে, তেমনি ব্যাবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এয়ারলাইনস ও ট্যুর অপারেটররা।
ট্যুরিজম ইউন্ডোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান মাসুম বলেন,‘ভাইরাস আতঙ্কে আমাদের বেশ কিছু পর্যটক তাদের পূর্বনির্ধারিত ট্যুর বাতিল করেছেন। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছি আমরা। শুধু পর্যটকরা নন, ব্যবসায়ীরাও সিঙ্গাপুরে যেতে চাইছেন না। এমনকি অন্য দেশে যাওয়ার সময় ট্রানজিট হিসেবেও সিঙ্গাপুরকে এড়িয়ে চলছেন যাত্রীরা।’
বাংলাদেশে পর্যটক আগমন ৬০ শতাংশ কমে গেছে বলে জানিয়েছেন বেসরকারি পর্যটন প্রতিষ্ঠান জার্নি প্লাসের প্রধান নির্বাহী (সিইও) তৌফিক রহমান। বলেন, ‘আমার ছয়টি গ্রুপের প্রায় ১০০ জন বাংলাদেশে ভ্রমণ বাতিল করেছেন। এতে অন্য মাত্রার ক্ষতি হচ্ছে। সরকারের উচিত প্রতি সপ্তাহে বাংলাদেশ করোনাভাইরাসমুক্ত—এই প্রেস নোট প্রতিনিয়তই আমাদের পর্যটক আসা দেশগুলোসহ বহির্বিশ্বে প্রচার করা।’
টোয়াব সভাপতি মো. রাফেউজ্জামান বলেন, আমরা বরাবরই বলে আসছি, বাংলাদেশ করোনাভাইরাসমুক্ত। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বুলেটিনগুলো আমাদের দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে সারা বিশ্বে পাঠানো দরকার। যাঁরা চীন, জাপান তথা আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন তাঁরা আমাদের দেশে আসতে পারেন।’
এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবেন বলে জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মহিবুল হক। বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যাত্রী কমে যাওয়ায় আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসও ক্ষতির মুখে পড়েছে। আমরা এ বিষয়ে পরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি লিখব দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য। আমরা বাংলাদেশকে নিরাপদ গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরব।’
উদ্ভূত পরিস্থিতিকে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটনের জন্য বড় ধাক্কা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বিশ্বের উদীয়মান পর্যটন গন্তব্যে থাকা চীনের আশপাশের সিঙ্গাপুর, জাপান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশ ঝুঁকিতে পড়েছে। এই প্রভাবের বাইরে নয় বাংলাদেশও।
আগের খবর:
করোনায় ৫ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতির আশংকা বিশ্ব এভিয়েশনে
করোনায় বড় ধাক্কাটা লাগবে এশিয়ার এভিয়েশনে
করোনা প্রভাবে জৌলুস হারিয়েছে সিঙ্গাপুর এয়ার শো
করোনার প্রভাবে ৫০ ভাগ পর্যটক কমবে থাইল্যান্ডে