ওদের কোনোদিনই ভুলতে পারব না
আমি চুপ থাকব ভেবেছিলাম, কিন্তু চুপ আর থাকতে পারলাম না। উচিত কথা না বলতে পারলে আমার মুখ নিশপিশ করে। মাত্র চার দিন আগে ৪জন আপন মানুষকে হারিয়েছি। রাতে ঘুম আশে না আর দিনের বেলায় ক্ষনে ক্ষনে চোখ ভিজে আসে। গলা ভারী হয়ে আসে। যে মানুষগুলোকে হারিয়েছি তারা আমার নিজ পরিবারের কেউ ছিল না। কিন্তু আমার অন্য আরেকটা পরিবারের সদস্য ছিলো। যে পরিবারের মানুষগুলোর সাথে আমি দিনে ২৪ ঘন্টার মাঝে ১৬ ঘন্টা কাটাই। আজ তাদের কথা বলব, তাদের ত্যাগ এর কথা বলব। কারন সবাই তাদের কথা ভুলে গেছে!
কেএইচএম শফি (KHM Shafey) আর শারমিন আক্তার নাবিলা (Nabila Farhin)। ১২ ই মার্চ,২০১৮ নেপালের বিমান দুর্ঘটনায় প্রান হারিয়েছে, আমার একটি ভাই আর একটি বোন।
শফি ভাইয়া বাবার একটি মাত্র ছেলে, ভালোবেসে বিয়ে করলো চাদের মত ফুটফুটে একটি মেয়েকে যে তার সাথেই চাকুরি করতো,যারা একজন আরেকজন এর জন্য ছিল পারফেক্ট।
নাবিলা ছোটো বেলায় বাবাকে হারিয়ে অনেক কষ্টে মানুষ হওয়া একটি মেয়ে। ভালোবেসে বিয়ে করা সংসারে শান্তি ছিল না। নিজের একমাত্র মেয়ে হিয়া কে নিয়ে তাই বাকি জীবনটা কাটাতে চেয়েছিল!
,
আজ আমি ক্যাপেটন আবিদ সুলতান (Capt. Abid Sultan) স্যার কিংবা কো-পাইলট মিস পৃথুলা রশীদ (Miss Prithula Rashed) নিয়ে কথা বলতে আসিনি। তাদের বীরত্বগাঁথা সবাই জানেন। সবাই মনে রেখেছেন। আজ আমি বলতে এসেছি আমার ভাই বোনের কথা। আপনারা কি জানেন সেদিনের সেই দুর্ঘটনায় শফি আর নাবিলা কিভাবে প্রান হারিয়েছে ???
প্লেনটি সেদিন যখন ফুটবল মাঠে এসে থামে তখন তাতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল। শফি ভাইয়া নিজ হাতে এসে কেবিনের ইমার্জেন্সি দরজা খুলে যাত্রীদের বের হয়ে যেতে বলছিল সেদিন।
মিস প্রিথিলা রশিদ কি করে ১০জন নেপালী যাত্রীর প্রান বাচিয়েছিলেন কিংবা বাঁচাননি সে তর্কে আমি জেতে চাইনা, এই সম্পর্কে একটি link আমি শেয়ার করেছি,কারো আগ্রহ থাকলে দেখে নিতে পারেন। কিন্তু শফি ভাইয়া যে নিজ হাতে ইমার্জেন্সি দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে বলেছেন যাত্রীদের সেটা আমার কথা না, এটা সেদিন বেচে যাওয়া নেপালী যাত্রীর কথা।
সব পেপার পত্রিকায়,খবরে ক্যাপেটন আবিদ সুলতান স্যার আর মিস পৃথুলা রশীদ-এর নাম আসছে। কিন্তু সবাই ভুলে গেছে, শফি ভাইয়া আর নাবিলার কথা। সেদিন চাইলে দরজা খুলে শফি ভাইয়া সবার আগে বেরিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু যে ট্রেনিং আমরা প্রতি বছর করি, ইমার্জেন্সিতে আগে যাত্রীদের নিরাপদে বের করতে হবে, যে শিক্ষা, যে মানবিকতা ছিল তা কেউ মনে করেনি। সবাই ভুলে গেছে। হুজুকে পাগল আমরা। সব সময়ের মত এবারও হুজুকের স্রোতে গা ভাসিয়েছি। নিজের প্রানের বিনিময়ে সেদিন সে যদি ৫টা প্রাণও বাঁচিয়ে থাকে তাহলে সেটা কি কোনো ইতিহাস এর চেয়ে কম??
এই দুর্ভাগা মানুষটার পুড়ে যাওয়া শরীরটা এখনও তার অসহায় পরিবারের কাছে পৌছায় নি। কবে পৌছাবে তাও কেউ জানে না। আর আরেকজন হতভাগ্য মানুষ নাবিলা। তার তো এখনো শরীরটাও খুজে পাওয়া যায়নি!
যাদের সাথে এতগুলো দিন একসাথে কাজ করেছি, হেসেছি, মজা করেছি, সেই তরতাজা মানুষগুলো মুহূর্তে নিশ্চিন্ন হয়ে গেল আর বিবেকবুদ্ধিহীন মানুষগুলোও তাদের ভুলে গেলো, এই চরম দুর্ভাগ্য কোথায় রাখি।
তাই আজ আফসোস হয়, শফি ভাইয়া যদি সেদিন দরজা খুলে নিজে আগে বের কেন হল না…!
আমাদের মত অকৃতজ্ঞ জাতির এই নির্বোধ স্বার্থপরতা যদি সে আজ দেখতো তখন গম্ভীর হয়ে মাথা দুলিয়ে শুধু বলত, “this is very pathetic miss”
কারন মানুষটা এমনি ছিল, সাধারন কিন্তু বিরল..
আর চশমা পরা ওই হাসিখুশি মেয়েটা, ওর কথা আর মনে নাই করি…
ওরা চলে গেছে আর সাথে নিয়ে গেছে আমার রাতের ঘুম। তোমরা কেউ ওদের মনে রাখ আর নাই রাখ, আমরা যারা ওদের চিনতাম,তারা ওদের কোনোদিনই ভুলতে পারব না!
ওরা চলে গেছে আর আমাদের জন্য রেখে গেছে বুক ভাঙ্গা কান্না…
২০১৮ সালের ১২ মার্চ নেপালে ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা নিয়ে একজন কেবিন ক্রুর ফেসবুক স্ট্যাটাস ( ২০ মার্চ ২০১৮) ।