ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের ‘ফ্লাইট ৩০২’ দুর্ঘটনার এক বছর
বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্সের নকশাকে দায়ী করে প্রতিবেদন
এক বছর পেরিয়ে গেল ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ৩০২ দূর্ঘটনার। শোকাবহ এই উড়োজাহাজ ট্যাজেডির এক বছর পূর্তিতে প্রিয়জন হারানো পরিবারগুলো মঙ্গলবার দূর্ঘটনাস্থলে এক শোকসভায় মিলিত হয়। এর একদিন আগে সোমবার ইথিওপিয়ান তদন্তকারি দল এক বছর আগের এই মারাত্মক দুর্ঘটনার জন্য বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স উড়োজাহাজের ত্রুটিপূর্ণ নকশাকে দায়ী করে প্রতিবেদন দেয়।
২০১৯ সালের ১০ মার্চ ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবারের বোলে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের ET302 ফ্লাইটটি কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়ার ছয় মিনিট পর বিধ্বস্ত হয়। নিহত হন ৩৩ টি দেশের ১৪৯ জন যাত্রী এবং আট জন ক্রু সদস্য।
১৩৬ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, উড্ডয়নের পর পাইলটদের বেশ কয়েকবার অটোমেশন ব্যর্থতা এবং সাংঘর্ষিক এলার্মের শিকার হয়ে হতে হয়, যেটির কারণে শেষ পর্যন্ত উড়োজাহাজটিকে আর রক্ষা করা যায়নি।
ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের ৩০২ ফ্লাইটটিতে ৩৩ দেশের নাগরিকদের অনেকেই কাজ করতেন জাতিসংঘে। মঙ্গলবার নিহত বিমানযাত্রী ও কেবিন ক্রুদের কয়েকশ আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধু বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ইথিওপিয়ায় ছুটে যান।
দূর্ঘটনা স্থলটিতে রাজধানি আদ্দিস আবাবা থেকে গাড়ি চালিয়ে যেতে তিন ঘন্টা লাগে। সেখানে শোকাবহ এই অনুষ্ঠানে যোগ দেয় কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা, ইতালি, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশের নিহতদের পরিবার।
শোক অনুষ্ঠানে গাছ লাগানো কর্মসূচির সাথে ছিল নিহতদের নাম স্মরণ। এসময় অনুষ্ঠানের আশপাশের এলাকায় নিহতদের স্বজন ছাড়া জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে এক কিলোমিটার পথ অবরোধ করে রাখে। এছাড়াও আদ্দিস আবাবাতে জাতিসংঘের কার্যালয়ে, বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের লোকজন প্রিয়জনের সম্মানে মোমবাতি প্রজ্বলন করেন।
এই দূর্ঘটনায় তিন সন্তানের পিতা জ্যাকসন মুসকনকে হারিয়ে এখনো শোকে মুষড়ে থাকেন স্ত্রী হুগুলেট ডিবেট। বিশ্ব সংবাদমাধ্যম রয়টার্সকে তিনি বলেন, “এতদিন পরও আমাদের মধ্যে সেই শোক আর আতঙ্ক তাড়া করে ফেরে, এই দূর্ঘটনা ভুলবার নয় যা অনেক কষ্টকর।”
তিনি আরো বলেন “আমি চাই পৃথিবী যেন কখনো ভুলে না যায় এই ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা। এমন ঘটনা আমাদের যে কারও জীবনে হতে পারে যদিও তা কখনো হওয়া উচিত নয়। ”
ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের কর্মীরা তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে পৃথক একটি অনুষ্ঠানে সমবেত হন। সেখানে মৃতদের ছবি সাজিয়ে রেখে সেখানে সাদা গোলাপ দিয়ে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা প্রকাশ করা হয়। এসময় একটি পর্দায় মৃতদের জীবিত অবস্থার বেশ কিছু ছবি অর্কেস্ট্রার সুরে সুরে প্রদর্শিত হয়।
এই ট্র্যাজেডিটি ইথিওপিয়া জুড়ে মানুষকে শোকে ডুবিয়ে দিয়েছিল, মধ্য ইথিওপিয়ার একটি ছোট্ট ঘুমন্ত গ্রাম আদাদিসহ, যেখানে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছিল এবং আগুনের শিখায় ফেটে গিয়েছিল।
“আমি কফি খাচ্ছিলাম হঠাৎ উচ্চ মাত্রার আওয়াজ শুনে আমি যখন আমার বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম তখন দেখলাম বিশাল বিস্ফোরণ এবং ধোঁয়ার কুণ্ড, যা আমার ঘর পর্যন্ত পৌঁছেছিল,” ,” সেদিনের কথা স্মরণ করেন ৬২ বছর বয়সী স্থানীয় কৃষক আবেরা লেনিজো ।
তিনি বলেন, “আমরা অনেকে কাঁদতে কাঁদতে দদুর্ঘটনার স্থলে ছুটলাম। তারপরে আমরা আমাদের স্থানীয় প্রশাসকদের ডাকলাম।”
দুর্ঘটনার পরপরই সরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও শোক জানাতে শত শত মানুষ আদাদিতে ছুটে আসে।
“আমাদের গ্রাম বিমান দুর্ঘটনার আগে খুব অচেনা ছিল,” আবেরা বলেছেন। “বিমান দুর্ঘটনার পরের দিনগুলিতে শোক প্রকাশকারীরা আমাদের অঞ্চলে এসেছিল। আমরা শোককারীদের খাবার দিয়ে বরণ করেছিলাম এবং তাদের দুঃখ প্রকাশ করেছি।”
এই দুর্ঘটনায় ইথিওপিয় এয়ারলাইন্সকে হতবাক অবস্থায় ফেলে দেয়। সংস্থাটির চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার তেওল্ডে জেব্রিমারিয়াম বলেছিলেন, “এয়ারলাইন্সের দীর্ঘ জীবনে বিমান দুর্ঘটনাটি আমাদের সকলের উপর প্রচুর শক্তি ব্যয় করেছে এবং অত্যন্ত মর্মাহত করেছে।” .
“তবে আমরা খুব শক্তিশালী ছিলাম, এমনকি দুর্ঘটনার দিনও আমরা দেরি না করে এবং কোনও বাতিল ছাড়াই সমস্ত বিমান উড়তে পেরেছিলাম,” কয়েক দশক ধরে লাভ ও উপার্জনের মাধ্যমে আফ্রিকা মহাদেশের বৃহত্তম বিমান সংস্থার অভিজ্ঞতার বরাত দিয়ে টেওল্ডি বলেছিলেন।
এর আগে ২০১৮ সালে ইন্দোনেশিয়ার লায়ন এয়ারে একই ধরণের বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স উড়োজাহাজ বিধবস্ত হয়ে ১৮৯ জন নিহত হয়েছিল। দ্বিতীয় দুর্ঘটনার পর (ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স ৩০২) মার্কিন বিমান প্রস্তুতকারীর উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিল।
একসময়ের সাড়া ফেলা বোয়িংয়ের সর্বাধিক বিক্রিত ৭৩৭ ম্যাক্সের ভাগ্য এখনও মাটিতেই পড়ে আছে। এই বিমান নির্মাতা ইথিওপিয়ার দুর্ঘটনার পর থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার লোকসান গুণেছে।
এ ঘটনার জেরে বোয়িং-এর সিইও-কে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়, শোকস্তব্ধ পরিবার থেকে শতাধিক মামলার মুখোমুখি হয় বিমান সংস্থাটি ।