ইতালিতে করােনায় মৃত্যু হাজার ছাড়িয়েছে, ডাক্তারের অভিজ্ঞতায় ‘সুনামি’

ইতালিতে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে করোনাভাইরাস। প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আনুপাতিক ১৭% হারে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে আর উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে মৃত্যুহার। বিশ্বে যেখানে করোনাভাইরাসের রোগীর মৃত্যু হার ৩ ভাগেরও কম, সেখানে ইতালিতে মৃত্যু হার ১৫ ভাগেরও বেশি। অপরদিকে আনুপাতিক হারে প্রায় ১৭% সুস্থ হয়েছেন ।

গতকাল বৃহস্পতিবার সবশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশটিতে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা ১,০১৬ জনে দাঁড়িয়েছে। আক্রান্ত ১৫ হাজার ১১৩ জন। সুস্থ হয়ে উঠেছেন ১,২৫৮ জন ।

করোনার তাণ্ডবে পুরো দেশ যেখানে অচল, সেখানে রেড জোনের আওতাভুক্ত ঘোষণার তৃতীয় দিনেও রেকডসংখ্যক ২৬৫১ জন নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে। একই সময়ে গত ২৪ ঘন্টায় মারা গেছে আরো ১৮৯ জন। যা বিশ্বের আক্রান্ত ১২৫টি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। রোম শহরে একজন ও ভেনিসে দুজন বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছে।

Travelion – Mobile

এদিকে বৃহস্পতিবার থেকে পুরো ইতালি ছিল অবরুদ্ধ ও নিস্তব্ধ। ফার্মেসি, সুপার সপ-আলিমেন্টারি ও ব্যাংক ছাড়া কোনো দেকান-পাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা ছিল না। দেশব্যাপী সুনশান নিরবতা, নেই কোনো কোলাহল-কর্মব্যস্ততা। পরিবহনে নেই কোনো যাত্রী। রাস্তাঘাট একেবারে জন-মানবশূন্য। একই সাথে করোনার ছোবলে ইতালির অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাবে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে মিলান স্টক স্টেঞ্জে (২৯) শতাংশেরও কিছু বেশি ধ্বস নেমেছে।

ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থাও সীমিত হয়ে গেছে। কয়েক হাজার ট্রেন টিকেট ও ফ্লাইট বাতিল করা হয়ে। লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। বিশ্বের অষ্টম অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশ ইতালির সবমিলিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। ইতালির বিভিন্ন শহর হতে বিভিন্ন দেশের ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। সবার মাঝে আতংক বিরাজ করছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রবাসীরা বিপাকে পড়েছেন।

আজ ইতালির খ্যাতিমান চিকিৎসক ও উত্তর ইতালিয় ভেরেসের মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান রবার্তো স্টেলা (৬৭ ) মারা যান। করোনায় আক্রান্তের কারণে তার শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা হয়। তার মৃত্যুতে ইতালির ডক্টরস ও জেনারেল প্রাক্টিশনার্স ফেডারেশন শোক জানিয়েছে। তারা মনে করেন, করোনার কারণে ইতালির যেসব চিকিৎসক ও নার্সরা বিপদের মুখোমুখি হচ্ছেন; তাদের বিষয়ে খেয়াল রাখবে সরকার।

ইতালিতে করোনাভাইরাস  চিকিৎসা
ইতালিতে করোনাভাইরাস চিকিৎসা

অন্যদিকে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় নিয়োজিত ইতালির একজন চিকিৎসক অভিজ্ঞতায় উঠে এসেছে, ভাইরাসটির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গা শিউরে ওঠা চাঞ্চল্যকর তথ্য। ইতালির হিউম্যানিটাস গাভাজেনি হসপিটালের ডা. ডেনিলে ফেসবুকে দীর্ঘ এক স্ট্যাটাসে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই ও অবহেলা সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি করোনাভাইরাসকে সুনামির সঙ্গে তুলনা করেছেন।

করোনাভাইরাস ইতালিতে মারণ থাবা বসিয়েই চলেছে। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস চীনের পর ভয়ঙ্কর হিসেবে দেখা দিয়েছে ইউরোপের এই দেশটিতে। এরই মধ্যে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে দেশটি। সেখানে মৃত্যের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২৭ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ১৯৬ জন। ইতালিতে একদিনেই নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন দুই হাজার ৩১৪ জন। চিকিৎসাধীন আছেন ১০ হাজার ৫৯০ জন।

তিনি লিখেছেন, এখানে আমাদের সঙ্গে কী ঘটছে এবং কী লিখবো তা নিয়ে অনেক ভাবনা-চিন্তার পর মনে হলো- চুপ থাকা দায়িত্ববানের কাজের মধ্যে পড়ে না। করোনাভাইরাসের দাপটের মুহূর্ত আমি বার্গামোতে কাটিয়েছি। আমি জানি যে, এই পরিস্থিতিতে আতঙ্ক তৈরি করা যাবে না। কিন্তু ভয়াবহতার বার্তা যখন মানুষের কাছে একেবারেই পৌঁছে না, তখন সেটি আর ভয়ের।

বার্গামোতে এক লাখ ২২ হাজার মানুষ বাস করে। মিলান থেকে ৩০ মাইল দূরের এই শহরে ১২৪৫ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে।

ডা. ডেনিলে ম্যাকিনি লিখেছেন, গত সপ্তাহে আমি পুরো হাসপাতাল পর্যবেক্ষণ করে দেখে অবাক হয়েছি। আমাদের বর্তমান শত্রু তখন পর্যন্ত এতো ভয়াবহ আকারণ ধারণ করেনি। হাসপাতালের ওয়ার্ড তখনো খালি ছিল, বিদ্যুৎও চলে যাচ্ছিল মাঝে মাঝে।

ডা. ডেনিলে ম্যাকিনি
ডা. ডেনিলে ম্যাকিনি

তিনি আরো লেখেন, বর্তমানের মতো নিরবতা আর হাসপাতালের করিডোরগুলোতে পরাবাস্তব শূন্যতা অতীতে আর কখনো দেখিনি। আমরা এমন এক যুদ্ধ শুরুর আগ মুহূর্তে আছি, যা এখনো সেই অর্থে শুরু হয়নি। অনেকে (আমিসহ) নিশ্চিত ছিলেন না যে এ জাতীয় বর্বরতা কখনো আসবে।

আমি এখনো মনে করতে পারছি যে, সপ্তাহখানেক আগে এক রাতে একজনের পরীক্ষার (করোনা) ফল জানার অপেক্ষায় আছি। যখন আমি এটা বুঝতে পারলাম, আমার আতঙ্ক বেড়ে গেল। আমি এখন দেখতে পাচ্ছি, কী ঘটতে যাচ্ছে। পরিস্থিতি এখন নাটকীয়ভাবে মোড় নিচ্ছে।

প্রকৃতপক্ষে এই ভাইরাস ‘বিস্ফোরিত’ হয়েছে। সময়ের পরিবর্তনে ভয়বহ আকার নিচ্ছে। হাসপাতালে খালি করা ওয়ার্ডগুলো ক্ষণিকের মধ্যে পূরণ হয়ে যাচ্ছে। এখন হাসপাতালে বেডের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এখন কাউকে সার্জারি করতে গেলেও করোনা পরীক্ষা করতে হচ্ছে।

চিকিৎসকের এই পোস্ট ৩৫ হাজারের বেশিবার শেয়ার করা হয়েছে। তবে ডা. ডেনিলে ম্যাকিনি সবাইকে অনুরোধ করেছেন, করোনাভাইরাসকে যেন কোনো ফ্লুর সঙ্গে তুলনা না করা হয়।

তিনি লিখেছেন, এখানে বাড়তি কোনো সার্জন নেই, ইউরোলজিস্ট নেই, অর্থোপেডিক্স নেই; আমরাই এই সুনামি মোকাবেলায় কাজ করে যাচ্ছি। আমি চিকিৎসকদের চোখেমুখে যে ক্লান্তি দেখেছি, তাতেই বোঝা যায় কী পরিমাণ চাপ তাদের ওপর পড়েছে।

চিকিৎসকরা ‘বেড’ সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এবং রোগীদের ধরে ওঠানো-নামানোর কাজ করছেন। এমনকি তারা থেরাপিস্টদের কাজ থেকে শুরু করে নার্সের কাজও করছেন। ওদিকে নার্সরা ছোখের পানি ফেলছেন সবাইকে বাঁচাতে না পেরে।

এখানে কোনো শিফট নেই, আলাদা কর্মঘণ্টা নেই। সামাজিক জীবন বলে কিছু নেই আমাদের। পরিবারের সদস্যরা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় তাদের সঙ্গে তেমনভাবে দেখা পর্যন্ত করছি না।

তিনি আরো উল্লেখ করেছেন, এরই মধ্যে তার অনেক সহকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্ত হয়ে তারা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!