আশকোনা ক্যাম্প নিয়ে চীনফেরত বাংলাদেশিদের চরম অসন্তোষ
চীন থেকে ফিরিয়ে আনা বাংলাদেশিদের শনিবার দেশে পৌছুনোর পরপরই নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর আশকোনা হাজী ক্যাম্পে। তবে সেখানে গিয়ে থাকার ব্যবস্থা দেখে চরম অসন্তোষ আর হতাশা প্রকাশ করেছেন অনেকেই। এক রুমে ৪০/৫০ জন করে রাখার ব্যবস্থা, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, ভয়াবহ মশার উপদ্রব, জীবাণুণাশক সামগ্রীর অভাব, নোংরা টয়লেটসহ নানা ধরনের ভোগান্তির কথা জানায় তারা। অভিযোগ করেন, এমন পরিবেশে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি বাড়ার পাশাপাশি অন্যান্য নানান রোগ-জীবাণুও দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে জানা গেছে, বাংলাদেশিদের অভিযোগসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রাণালয়, স্বাস্থ্য বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো বিকাল ৫ টা থেকে জরুরী বৈঠকে বসেছে। সকল ঘাটতি পুরণে দ্রুত ব্যবস্থা হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আশা করছেন।
শনিবার দুপুরে চীনের উড়ান থেকে বিশেষ ফ্লাইটে দেশে ফেরা ৩১৪ জনের মধ্যে ৭ জনের শরীরে তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রির বেশি পাওয়ায় তাদেরকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বাকী ৩০৭ জনকে নিয়ে আসা হয় আশকোনার হাজী ক্যাম্পে।
আশকোনা হাজী ক্যাম্পের পরিচালক সাইফুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, ক্যাম্পের তিন তলার চারটি ডরমেটরিতে ৩০৭ জনকে রাখা হয়েছে। প্রতিটি কক্ষে ৪০/৫০ জন করে প্রতি তলায় ১০০ জনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। থাকার জন্য তাদের বিছানা, চাদর, বালিশ, মশারি, ঔষধসামগ্রি, পানি ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা রাখা হয়েছে। আছে সকাল ও বিকেলের নাস্তাসহ পাঁচ বেলা খাবারের ব্যবস্থা। শিশু ও নারীদের জন্যও আছে আলাদা খাবার ও থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেও জানান।
তিনি জানান, তারা যেন বাইরে বের না হোন সেজন্য তৃতীয় তলার সিড়ির প্রবেশ পথে কলাপসিবল গেইট লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৪ দিনের মধ্যে সেখান থেকে কেউ বের হতে পারবেন না। তাদেরকে যারা সেবা দেবেন তাদেরকেও বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
তবে এসব ব্যবস্থা থাকলেও থাকার পরিবেশ নিয়ে চরম অসন্তোষ জানিয়েছেন ক্যাম্পে থাকা বাংলাদেশিরা। উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিভু বড়ুয়া বলেন,“এখানে এসে দেখি এক কক্ষে ৪০ থেকে ৫০ জনের মত থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এক বিছানা থেকে আরেক বিছানার দুরত্ব মোটে কয়েক হাত। একজন হাঁচি দিলেই তা আরেকজনকের মধ্যে সহজে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমাদের এমন পরিবেশে রাখা হবে জানলে চীন থেকে দেশে ফেরত আসতাম না, কারণ আমরা সেখানে নিজ নিজ ডর্মিটরির কক্ষে অনেক নিরাপদে অবস্থানের সুযোগ ছিল।”
উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী সরওয়ার জানান, গণরুমের যেভাবে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে ভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে নয় বরং ভাইরাসে আরো আক্রান্ত হওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বলেন, “এখানে সবাইকে আমরা চিনিনা। এদের মধ্যে কেউ যদি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকে তবে তার থেকে সেটি সহজেই অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। এই আশংকা ছাড়াও আছে ভয়াবহ মশার উপদ্রব। এখানে আসার পর থেকেই মশার জন্য এক মুহুর্তও বসতে পারছি না। তাছাড়া মশারির সরবরাহ করা হলেও তা টাঙানোর মত কোন ব্যবস্থা এখানে রাখা হয়নি।”
থাকার এমন ব্যবস্থা দেখে ফেরত আসা বাংলাদেশিদের উইচ্যাট গ্রুপে (I am in Wuhan now) তীব্র অসন্তোষ আর ক্ষোভ প্রকাশ করে চীনে বাংলাদেশ দূতাবাস কর্মকর্তাদের নজরে বিষয়গুলি আনার চেষ্টা করেন অনেকেই। এদের মধ্যে কেউ কেউ চীন ছেড়ে এখানে আসার জন্য আফসোস করে Leaving wuhan is my biggest mistake, just not corona virus, there is a chance of every diseases here…, Hey guys . can I go back to china? We came with fear of corona and will go back to china with dengue এমন নানা ধরনের বার্তা গ্রুপে পোস্ট করেন।
সেন্ট্রাল চায়না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আবদুল্লাহ নিজেদের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘যেই গণরুমে বড়জোর ১০/১৫ জন থাকার ব্যবস্থা করা যায় সেখানে রাখা হয়েছে ৫০ থেকে ৬০ জন করে শিক্ষার্থী। পরিচ্ছন্নতা নিয়ে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “যেসব কক্ষে আমাদের রাখা হয়েছে সেগুলো তেমন পরিচ্ছন্ন নয় তার উপর বাথরুমে সকলের ব্যবহারের জন্য রাখা হয়েছে ছোট কয়েক টুকরো সাবান। এভাবে সবাই যদি সব কিছু এভাবে শেয়ার করে ব্যবহার করি তাহলে আমাদের মধ্যে অন্য নানা রোগ-জীবাণুও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে।”
আরেক শিক্ষার্থী ইব্রাহীম মাহমুদ, জনান ২৪ ঘন্টার ধকল পোহানোর পর আমরা অনেক কষ্টে বাংলাদেশে এসেছেন। দীর্ঘক্ষণ ক্ষুধার্ত আর ক্লান্ত থাকায় আমাদের একটি আদর্শ বিশ্রামের দরকার ছিল। তবে বিশ্রামের বদলে উল্টো ভোগান্তি হওয়ার ক্ষোভ নিয়ে বলেন, “এখানে এসে আমরা যেন কড়াই থেকে চুলোতে এসে পড়লাম। শুরু থেকেই আছি মশার উৎপাত আর ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্কে। তার উপর যোগ হয়েছে সামনের দিনের অনিশ্চয়তা আর অব্যবস্থাপনার ভীতি। এভাবে কয়দিন এখানে থাকা যাবে তাই ভাবছি।”
এদিকে ক্ষোভ প্রকাশ করে কয়েকজন নারী শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, নারীদের কক্ষে পর্যাপ্ত পর্দা আর প্রাইভেসির ব্যবস্থা করা হয়নি। অন্যদিকে তাদের জন্য রাখা হয়েছে কম্বাইন্ড বাথরুম। সবমিলিয়ে নিজেদের থাকা নিয়ে ভাইরাস ঝুঁকির পাশাপাশি নানা ধরনের ভোগান্তির আতঙ্কে সময় কাটছে বলে জানান তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উহান ফেরত বাংলাদেশি এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, “মনে হচ্ছে এভাবে চীন থেকে বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্তটা বড় একটা ভুল ছিল। পরিবার পরিজন নিয়ে অনেক আশা করে ভাইরাসের দূর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে দেশে এসেছি। তবে এখানে আমাদের জন্য ব্যবস্থা দেখে সত্যিই অনেক হতাশ আর ক্ষুব্ধ হয়েছি।”
পরিবার নিয়ে এমন দূর্ভোগে পড়ার অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে তিনি আরো বলেন, যাদের পরিবার আছে তাদের জন্যেও গণরুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমার স্ত্রী আর ছোট মেয়েকে রাখা হয়েছে এক রুমে আর আমাকে রাখা হয়েছে অন্য রুমে। এ অবস্থায় তাদের কিছু জরুরী প্রয়োজন হলে কি করব কোন ধারণা নেই। আছে মশার তীব্র উপদ্রবের সাথে গরম পানি, অপরিচ্ছন্নতাসহ নানা ধরনের সংকট। হাজী ক্যাম্প নিয়োজিত স্ট্যাফদের বিরুদ্ধে চরম অসহযোগিতার অভিযোগও তোলেন তিনি। বলেন, “এমন বিপদে পড়ব এখানে এসে তা আমাদের কল্পনাতেও ছিলনা।”
আগের খবর
চীন থেকে বিশেষ ফ্লাইটে দেশের পথে বাংলাদেশিরা
চীন থেকে বিশেষ ফ্লাইটে দেশের পথে বাংলাদেশিরা
উহান বিমানবন্দরে দেশে ফেরার অপেক্ষায় বাংলাদেশিরা
চীনের উহানে অবরুদ্ধ বাংলাদেশিরা অবশেষে দেশে ফিরছে