‘আমাদের বীর’—যারা গিয়েছিলেন মৃত্যুপুরীতে
করোনাভাইরাস উপদ্রুত চীনের উহান থেকে বাংলাদেশিদের উদ্ধার মিশনের বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনাকারী একজন পাইলটকে ভিসা দিতে স্বীকৃতি জানিয়েছে সিঙ্গাপুর। মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানিয়েছেন নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণ দেখিয়ে বিশেষ ফ্লাইটের ক্রুদের অন্যদেশে ঢুকতে দিচ্ছে না।
চিকিৎসা সেবায় শীর্ষে থাকা সিঙ্গাপুর যখন করোনাভাইরাস অঞ্চল ঘুরে আসা একজন পাইলটের ঝুঁকি নেওয়ার সাহস দেখাতে পারে না, তখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না কতটা ঝুঁকি মাথায় নিয়ে মৃত্যুপুরী উহান মিশনে অংশ নিয়েছিলেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পাইলট-কেবিনক্রুরা আর চিকিৎসা দলের সদস্যরা।
মৃত্যুপুরী ক্রমশ ভয়ানক হয়ে উঠেছে চীনের করোনাভাইরাস। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত আর আক্রান্তের সংখ্যা। এই ভাইরাস এতটাই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে যে তা কল্পনারও বাইরে। এ পর্যন্ত মৃতদের অধিকাংশই চীনের হুবেই প্রদেশে রাজধানি উহানের। যেখান থেকে ছড়িয়েছে এই ভাইরাস। এই প্রদেশকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে সারা বিশ্বের সঙ্গে।
বলা হচ্ছে এই নগরীর আকাশে বাতাসে মিশে আছে ভাইরাস। ছড়িয়ে পড়ছে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস আর হাঁচি কাশি এমনকি চোখের মাধ্যমেও। যেই নগরীর ঘুম ভাঙে লাখ লাখ মানুষের ব্যস্ততা আর কোলাহলে সেই নগরী যেন এখন মৃত্যুপুরী। ভুতুড়ে শহর।
পড়াশোনার সুবাদে এই শহরেই বসবাস প্রায় ৫০০ বাংলাদেশির। তবে ২৩ জানুয়ারির লক ডাউনের পর তাদের অনেকেই আটকা পড়েছিলেন সেখানে। একদিকে ছিল বাইরে বেরিয়ে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্ক অন্যদিকে গৃহবন্দি জীবন। সবমিলিয়ে নানারকম অনিশ্চয়তা আর আশঙ্কায় দিন কাটছিল অনেক শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের। দীর্ঘ যোগাযোগ আর টানা আবেদন চলল দূতাবাসে। আকুতি জানাল হল, দেশে ফিরে আসার।
৩১ জানুয়ারি, ২০২০। রাত ১০ টা। চীনের উহানের তিয়ানহে বিমানবন্দরে অবতরণ করে বিশেষ ফ্লাইট বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর। এটিতে করেই দেশে ফিরবেন মৃত্যুপুরীতে আটকে পড়া এবং দূতাবাসের মাধ্যমে আবেদন করা বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন করা ৩১৬ জন বাংলাদেশি।
দুই সপ্তাহের অপেক্ষার কথা বলা হলেও তিনদিনেই চীন সরকারের কাছে প্রধানমন্ত্রী অনুরোধ পাঠিয়ে করা হয়েছে উহানে অবরুদ্ধদের দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা । অনুমতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উহানে পাঠানো হয় চিকিৎসক দলসহ উদ্ধারকারী ফ্লাইট । তাই এ নিয়ে আগ্রহ আর আনন্দের কমতি ছিল না মৃত্যুপুরীতে আতংকের মধ্যে থাকা বাংলাদেশিদের। এতদিনের কষ্ট আর আতঙ্ক কেটে গিয়ে তাদের চোখেমুখে দেখা দেয় আশার ছটা।
১ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সময় সকাল ১০ টায় বাংলাদেশিদেরকে নিয়ে উহানের তিয়ানহে বিমানবন্দর ছাড়ে বিশেষ এই উদ্ধারকারি উড়োজাহাজ। যাত্রীর মধ্যে ৩০১ জন প্রাপ্তবয়স্ক, ১২ জন শিশু এবং তিন জন নবজাতক ছিল।
টানা চার ঘন্টার এই ফ্লাইটটি স্থানীয় সময় বাংলাদেশ সময় দুপুর ১১ টা ৫০ মিনিটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে । যারা এখন আশকোনা হজ ক্যাম্পে নিবিড় পর্যবেক্ষণর আছেন এবং এ পর্যন্ত কারও কাছে ভাইরাসের লক্ষণ পাওয়া যায়নি।
চীনের উহানের বিশেষ ফ্লাইটটি পরিচালনা করেছেন ক্যাপ্টেন মাহতাব, ক্যাপ্টেন ইলিয়াস ও ক্যাপ্টেন মেহেদি। তাদের সাথে ছিলেন ১১ জন কেবিনক্রু, ৩ জন ককপিট ক্রু ও ২ জন প্রকৌশলী। যাত্রীদের সেবা ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার দায়িত্বে ছিল ৩ সদস্যের বিশেষ মেডিকেল টিম। এই টিমে ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তিন জন চিকিৎসক মেজর ডা. মিনহাজ, মেজর ডা. ফাতেহা এবং ডা. মাহবুব।
যেই নগরী মৃত্যুর ফরমান নিয়ে প্রহর গুণছে সেই নগরীতে মৃত্যুভয় কাটিয়ে যেন আশার ফেরিওয়ালা হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটটি। এতে একবুক সাহস আর দেশপ্রেম নিয়ে এসেছেন যেন একঝাঁক নিবেদিতপ্রাণ বীর।
উহান থেকে বাংলাদেশি ফিরিয়ে আনার সংবাদে বার বার আমাদের চোখ আটকালেও এসব বীরদের কথা যেন উপেক্ষিত থেকে গেছে। অথচ দেশের স্বার্থে ঝুঁকি নিয়ে করে তারা ছুটে গেছেন উহানের মৃত্যু নগরীতে। দেশের ভাইদের ফিরিয়ে আনার গুরুত্বপূর্ণ মিশনে।
নিজেদের পর্যাপ্ত নিরাপদ ব্যবস্থা নিশ্চিত করে পুরো উড়োজাহাজটিকেকে জীবাণু ও দূষণমুক্ত রাখতে আন্তরিকতার কমতি ছিলো না চিকিৎসক আর করুদের কারোরই। । স্বল্প সময়ের প্রস্তুতিতে নিরাপদে বাংলাদেশিদের দেশে ফিরিয়ে নেয়ার সার্বিক আয়োজনে ছিলনা কোন ক্রুটি বা ঘাটতি।
বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটটিতে দেশে ফেরা বাংলাদেশিদের মুখে আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব আনসাং হিরোজ’দের কথা এভাবেই ওঠে এসেছে।
উহানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক শামীমা সুলতানা তার ফেসবুক পোস্টে ফ্লাইটের ভেতরের কয়েকটি ছবি দিয়ে লেখেন, “যাদের আন্তরিকতায় মুগ্ধ । সব সময় আমাদের পাশে ছিলেন। ওদের মনে কোন ভয় দেখিনি,ভালবাসা দেখেছি। সব সময় আমাদের সেবা দিয়ে গেছেন.বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সেসের এই সকল কর্মকর্তাগনকে অসংখ্য ধন্যবাদ”।
দেশে ফেরা আরেক বাংলাদেশি উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অর্পণ বড়ুয়া জানান, বাংলাদেশ বিমানের বিশেষ ফ্লাইটটিতে উঠতে তাদের বাসে করে টার্মিনাল থেকে অনেক দূরে রানওয়ের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হয়।
তিনি বলেন, “বিমানবন্দরের নানা ধকল আর দীর্ঘ অপেক্ষার পালা শেষে আমরা যখন সকালে বিমানে উঠলাম তখন কেবিন ক্রুদের আন্তরিকতা আর সেবায় আমাদের মধ্যে বয়ে গেল সস্তির নিঃশ্বাস। আমাদের নিরাপদ ও সুস্থ ভ্রমণে তাদের কোন কাপর্ণ্য চোখে পড়েনি। তাদের দেখে মনে হয়েছিল দূর্যোগ থেকে রক্ষা করতে আমাদের জন্য ছুটে এসেছেন কিছু দেবদূত”।
ফ্লাইটের আরেক যাত্রী বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ইব্রাহীম মাহমুদ উদ্ধারকারি দলের সেবার মানসিকতাকে প্রশংসা করে বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম কেবিন ক্রু কিংবা ফ্লাইটের অন্য সদস্যরা আমাদের ধারে কাছে ঘেঁষবেন না। অথচ তারা প্রথমেই বিমানে প্রবেশের আগে আমাদের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করেন। আমাদের মাস্ক ও হ্যান্ড গ্লাভস খুলে আমাদের নতুন মাস্ক পরিয়ে স্যানিটাইজার দিয়ে হাত জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা করেন”।
ফ্লাইটে প্রত্যেক যাত্রীর সেবায় কোন কমতি ছিলনা জানিয়ে তিনি আরো বলেন, “আসনে বসার পর আমাদের প্রত্যেককে একটি করে হ্যান্ড স্যানিটাইজিং লোশন দেয়া হয়। কিছুক্ষণ পর পর বিমানে আমাদের সেটি দিয়ে হাত পরিস্কারের ঘোষণা আসছিল। এছাড়া মেডিকেল টিম নিয়োজিত ছিল আমাদের শরীরের খোঁজ খবর রাখার কাজে। এসময় তাদের মধ্যে ভীতি বা অবহেলার কোন চিহৃ আমি দেখিনি।”
বিশেষ এই বিমান নিয়ে বাংলাদেশের কয়েকজন চিকিৎসকও ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে তাদের সাধুবাদ জানিয়েছেন। এর মধ্যে ভাইরাল হয় ডা. আবির শাকরান মাহমুদের একটি ফেসবুক পোস্ট। এই পোস্টে তিনি উহানে যাওয়া বিশেষ মেডিকেল টিমের সাথে সেলফি তুলে তাদের “ Our real heroes” অ্যাখা দিয়ে ফ্লাইট ক্রুদের প্রশংসা করেন।
আরেক ভাইরাল পোস্ট দেখা যায় ডা. মারুফুর রহমান অপুর। তিনিও উহানে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসার কাজে যাওয়া চীনা চিকিৎসকদের মত বাংলাদেশি এসব চিকিৎসক ও বিমানের ক্রুদের বীরত্বের কথা তুলে ধরেন।
প্রসঙ্গত ভয়াবহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সারাদেশ থেকে ৬ হাজার মেডিক্যাল কর্মীকে উহান শহরে পাঠায় চীন সরকার। এই ৬ হাজার ডাক্তার-নার্সের সবাই করোনাভাইরাসের হাত থেকে বেঁচে ফিরতে পারবেন কিনা, তা আসলে কেউ জানে না!
তাই জাতীয়ভাবে চীন এসব নার্সদের “সাদা পরী” আর ডাক্তারদের “বীর” বলে অভিহিত করে। তবে বাংলাদেশ বিমানের উদ্ধারকারী ফ্লাইটের সদস্যরা চিকিৎসা দলের সদস্যরাও এমন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উহান ছুটে গেলেও তাদের কপালে জুটেনি কোন বীরত্বের অভিধা বা খেতাব ।
তাই এ নিয়ে আফসোস জানালেন চীনফেরত অনেক বাংলাদেশি। তবে তাদের মনে বীর হিসেবেই আজীবন গেঁথে থাকবেন মানবতার ফেরিওয়ালা উহান উদ্ধার মিশনের ‘আনসাং হিরোজ’রা।
লেখক: পিএইচডি শিক্ষার্থী, সেন্টাল চায়না বিশ্ববিদ্যালয়, উহান, চীন