মাউন্ট ফুজি-বিশ্বের সবচেয়ে সৌন্দর্যময় পর্বতশৃঙ্গ। ১২ হাজার ৩শ’ ৮৯ ফুট উঁচু সুপ্ত আগ্নেয়গিরির এ পর্বতটি প্রকৃতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। কখনো স্থানীয়ের কাছে উপাসনার আরাধ্য, কখনো শিল্পীর চোখে ক্যানভাস। কখনো-বা পর্যটকের প্রশ্নাতীত গন্তব্য।
ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির এই সুউচ্চ জাপানি পর্বতটি যার চোখে যেমনই হোকনা কেন, পৃথিবীর বুকে প্রকৃতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি নিঃসন্দেহে। কারো কারো মতে, হিমালয়ের পরে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর পর্বত এই মাউন্ট ফুজিই। জাপানীদের কাছে বড়ো পবিত্র স্থান মাউন্টেন ফুজি ।
এই পর্বতটি থেকে সর্বশেষ অগ্ন্যুৎপাত হয়েছিল তিন শতাব্দী আগে। তারপর থেকে আজ অব্দি এটি সৌন্দর্য্য বিলিয়ে গেছে অকাতরে। ইউনেস্কোর বিশ্ব প্রাকৃতিক হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃত মাউন্ট ফুজির সৌন্দর্যের আকর্ষনে বছরজুড়ে থাকে বিশ্ব পর্যটকের ভীড় । প্রতি বছর লাখো পর্যটক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে যান সেখানে।
আমারও সৌভাগ্য হয়েছে জাপানের রাজধানী টোকিওর অদূরে হনশু দ্বীপে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে সৌন্দর্যময় পর্বতশৃঙ্গ এই মাউন্ট ফুজির কাছে যাওয়ার। আমার অনুভূতির গল্প বলার আগে জানিয়ে রাখি জাপান সফরের পেছনের গল্প।
এই কর্মসূচির অধীনে ‘জাপান শিল্প ভ্রমণ ও উন্নয়ন (Japan Industrial Tour and Development)’ শীর্ষক সপ্তাহব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মশালায় যোগ দেয় ৩৫ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল। দলে ছিলেন শিল্পপতি, তরুণ উদ্যোক্তা, বিপণন নির্বাহীসহ নানা পেশাদার। ঐ দলের সদস্য হয়ে কর্মশালায় অংশ নেওয়ার সুযোগ হয় আমারও। সেই সুবাধে দেখা হয়ে গেল সূর্যোদয়ের দেশ জাপান।
৫ অক্টোবর থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত দশদিন জাপান অবস্থানকালে দেশটির ঐহিত্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, শিল্পের সাথে অনেকটা জানা হয়। পাশাপাশি দেখা হয়ে যায় বিশ্বখ্যাত অনেক ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান। এর মধ্যে বড় আকর্ষনটাই ছিল বিশ্বের অন্যতম সুন্দর পর্বত ‘মাউন্ট ফুজি’ আর তার ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি।
বাংলাদেশ থেকে জাপানে যাওয়ার সরাসরি কোন বিমান নেই। যেতে হয় বিদেশী বিমানে ট্রানজিট হয়ে। আমরা গিয়েছিলাম থাই এয়ারওয়েজে ব্যাংকক ট্রানজিট হয়ে। চট্টগ্রাম থেকে যাত্রা করায় আমাদের নিতে হয়েছে দুটি ট্রানজিট। চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দর এবং সেখান থেকে থাই এয়ারওয়েজে ব্যাংকক সুবর্নভুমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এরপর একই সংস্থার অপর ফ্লাইটে জাপানের নারিতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌছি।
এখানে বলে রাখা প্রয়োজন আমি সঙ্গী হয়েছিলাম আমারই কর্মপ্রতিষ্ঠান ডায়মন্ড সিমেন্টের পরিচালক, চট্টগ্রামের বিশিষ্ট শিল্প উদ্যােক্তা লায়ন হাকিম আলীর। জাপানের পুরো সফরটা তাঁরই ছায়ায় ছিলাম আমি। সফরের শেষদিন ১৪ অক্টোবর পৃথিবীর বিখ্যাত পর্বতমালা মাউন্ট ফুজি ভ্রমনের সৌভাগ্য হয় আমাদের।
রাজধানী টোকিও থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে শিজুকা আর ইয়ামানশি প্রদেশের সীমান্তে হনশু দ্বীপে অবস্থিত মাউন্ট ফুজি। জাপানিদের কাছে এটি শুধু একটি পর্বত নয়; অন্যতম জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতীকও বটে। বরফে ঢাকা ঘুমন্ত এই আগ্নেয়গিরি কত কবির কল্পনাকে সমৃদ্ধি করছে, তার ইয়ত্তা নেই। সবকিছু মিলেই বাস্তব সৌন্দর্যের ভূমি (land of real beauty) বলা চলে।
ফুজি দর্শন নির্ভর করে আবহাওয়ার মেজাজের ওপর। মেঘ বা কুয়াশায় ঢাকা দিন আপনাকে হতাশ করতে পারে। তাই মাউন্ট ফুজি দেখে আসতে চাইলে বর্ষা আর শীত মৌসুম এড়িয়ে যেতে হবে। আর যারা পর্বতটিকে আলিঙ্গন করতে চান মানে পর্বোতারোহণের জন্য আসতে হবে জুলাই-আগস্ট মাসে।
মাউন্ট ফুজির অপার সৌন্দর্য্য উপভোগের সবচেয়ে উপযুক্ত সময় খুব সকাল আর শেষ বিকেল। আর যাতায়াতের সহজ ও চমৎকার উপায় হল ট্রেন। তবে আমরা সকালের সময় বেছে নিলেও গিয়েছিলাম বাসে।
অনেক ভোরে নাস্তা সেরেই টোকিও’র হোটেল থেকে হাকিম স্যারসহ যাত্রা শুরু করি। আগের দিনই স্থানীয় সানরাইজ ট্টাভেলস এন্ড ট্যুর কোম্পানী থেকে মাউন্ট ফুজি ভ্রমনের প্যাকেজ বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। জনপ্রতি ১৭ হাজার ৫ শত জাপানি ইয়েন (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৩ হাজার ৬ শো টাকা)।
আমাদের হোটেল টোকিও কেনসো সেন্টার হতে সাত মিনিট পায়ে হেটে ওসিদা ট্রেন স্টেশনে পৌছি। সেখান থেকে টাবো ইসেসাকি লেনে আসাকোসা স্টেশনে গিয়ে আবারও ৫ মিনিট পায়ে হেটে আসাকোসা ভিউ হোটেলে আমাদের জন্য নির্ধারিত ট্যুর কোম্পানী গাড়িতে উঠি।
বাসে ১৮ জন পর্যটকের মধ্যে আমরা দুজন বাংলাদেশি। বাকি ১৬ জনের মধ্যে ৫ জন অস্ট্রেলিয়ান, ২ জন জার্মান, বকিরা জাপানের আশেপাশের দেশের।
সবাইকে নিয়ে গাড়ি রওনা হয় মাউন্ট ফুজির উদ্দেশ্য। ভ্রমণ গাইড ছিলেন সানরাইজ ট্টাভেলস এন্ড টুরের মিজ হিকারি। জাপানী ভাষা হিকারির বাংলা অর্থ আলোকবর্তিকা, জেনে নিয়েছিলাম তার কাছ থেকে। চুপিসারে পাঠকদের জানিয়ে রাখছি পুরো সফরে সত্যি আলো ছড়িয়ে ছিলেন হিকারি!
রাস্তাটি খুব মনোরোম। দুপাশে সারি সারি বৃক্ষরাজি, অনেকটা আমার দেশের বান্দরবান নীল গিরির মতোই। পাহাড়ে মেঘের খেলা সত্যিই অপূর্ব। গাড়ি চলছে আর চলছে। কোথাও পাহাড়ের উপর উড়াল সেতু আবার কোথাও টানেল। রিলাক্সের জন্য মাঝে দুবার যাত্রা বিরতি দেওয়া হল।
পর্বতের একেবারে শীর্ষে উঠতে গেলে দশটি স্টেশন পার হতে হয়। পঞ্চম স্টেশন পর্যন্ত গাড়িতে ওঠা যায়। এরপর হাটা পথ। সাধারণত পবর্তরোহীরাই সে পথে যান। বেশিরভাগ পর্যটকের শেষ গন্তব্য পঞ্চম স্টেশন পর্যন্ত। তাই এটাকে বেশ সুন্দর করে গড়ে তোলা হয়েছে। থিম পার্ক, রিসোর্ট আর রেস্তোরাসহ আছে অনেককিছু।
আবহাওয়া অনুকুলে না থাকলে পঞ্চম স্টেশন পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব নয়। না দেখে ফিরে আসা বিশ্ব পর্যটকের পরিসংখ্যানটাও নেহাত কম নয়। আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন। আবহাওয়া অনুকুলে ছিল। নির্বিঘ্নে পঞ্চম স্টেশনে গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গেলাম। অবশেষে দেখা পেলাম আকাশছোঁয়া পাহাড় ‘মাউন্ট ফুজি’র ।
আমরা পঞ্চম স্টেশন থেকে হাঁটতে শুরু করলাম। চারিদিকে কি সবুজ। যে পথ দিয়ে চলছি কালো মাটি আর পাথরে ছড়ানো। আসলে ফুজির তলদেশ নাকি সবসময়ই জ্বলতে থাকে। আর উপরের অংশ তো বছরের অধিকাংশ সময়েই বরফে ঢেকে থাকে। এতো চমৎকার এখানকার ল্যান্ডস্ক্যাপ, ফিরে আসতে ইচ্ছে করে না।
এবার মধ্যহৃ ভোজের পালা। রিসোর্ট ইন ফুইওকয়াগুসিকু রিসোর্টে অর্ডার করে রেখেছি ট্যুর অপরারেটর। হিকারি নিয়ে গেলেন সেখানে। রিসোর্টটা আমার খুব মনে ধরেছে। খুব সুন্দর পরিবেশ। চারিদিকে মেঘের খেলা। পাশেই লাগায়ো থিম পার্ক।
বুফে খাবার। আমাদেরকে ভেজেটেরিয়ান টেবিলে বসিয়ে দিলো। টেবিলে দেখলাম ছোট চুল্লী। সেখানে সেদ্ধ হচ্ছিলো সামুদ্রিক মাছ, বাংলা কদু, শিম, মাশরুম ও বিভিন্ন জাপানি সবজী। পাশে সাজিয়ে রাখছে একটি বেগুনি, ২ টি ঢেরশ, কিছু মিস্টান্ন। পাশে বুফে টেবিল সবার জন্য উন্মুক্ত। সেখানে আছে ভাত, সি ফিশ, অক্টোপাশ ইত্যাদি ।
আমাদের খাওয়ার সময় ছিল ২৫ মিনিট। পেট ভরে খাওয়ার পর গেলাম রেস্টরুমে। বের হয়ে দেখলাম আমাদের রেখে চলে গেছে সবাই। এদিক-ওদিক ঘুরে সঠিক পথের দিশা পেলাম না। শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করলো গাইড হিকারি । তিনি আবার ফিরে আসেন আমাদের নিতে।
ফুজির চারদিকে মনোরম পরিবেশের পাঁচটি লেক রয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০০ মিটার উপরে অবস্থিত। প্রধানটি হল কাওয়াগুচিকো; মাউন্ট ফুজিকে কাছ থেকে দেখা আর পাহাড়ে আরোহণের জন্য ভাল বেস স্টেশন। আমাদের শেষ গন্তব্যে ছিল এই লেক; যেখানে ক্রুজে আর ক্যাবল কারে ঘুরে পাওয়া যায় ফুজির ঘনিষ্ট সানিধ্যে ।
বাসে করে গেলাম লেকের পাড়। সেখানে পৃথিবীর নানা দেশের পর্যটকে টাসা একটি ক্রুজে ২০ মিনিট ভ্রমণ করলাম। সে এক অপরুপ দৃশ্য। অনেকটা আমাদের ফয়’স লেক যেন। খুব কাছ থেকে দেখতে পেলাম ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরিসহ বরফে ঢাকা মাউন্ট ফুজির উচু শৃঙ্গগুলো।
ক্রুজ শেষে লেক পাড় থেকে পায়ে হেটে গেলাম আরও সামনে। এবার চড়লাম ক্যাবল কারে। সময় ছিলো ১৫ মিনিট। চারপাশে আকাশ ছোঁয়া পর্বতমালা, কোথাও রোদের ঝিলিক, কোথাও পাহাড়ের ছায়া। দূর্গম পাহাড় কেটে করা হয়েছে গলফ কোর্ট, ছোট ছোট কটেজ, গেস্ট হাউজ, নাম না জানা ফুলের বাগান।
এয়ার টাইট কাচের মোটা জানালা দরজা বেষ্টিত চালকহীন ক্যাবলকার কখনও বসে, কখনো ছবি তুলে, কখনও ভিডিও করে যে আনন্দ উপভোগ করলাম তা বর্ণনার ভাষা আমার নেই। শেষ স্টেশন ছুঁয়ে আবার নেমে আসলাম ।
এরপর ফিরতি যাত্রা। বাসে চড়ে ফেরার পথে প্রায় ১ ঘন্টা পর দেখা হল মাউন্ট হাকুনি। নিচে সাগর উপরে পাহাড় অপরূপ সৌন্দর্য। হাকুনি রেস্টহাউজের সামনে নামিয়ে আমাদের প্রত্যেককে ৬০০ ইয়েনের একটা ডিসকাউন্ট কার্ড ধরিয়ে দিলেন গাইড। সাথে একটা গিফট ভাউচার। খুলে পেলাম দুটি ঝুনঝুনি। ডিসকাউন্ট কার্ডে স্টারবার্কে কফি খেলাম।
সেখান থেকে একটানা আড়াই ঘন্টা বাসে চড়ে পৌঁছলাম উদাওয়ারা রেল স্টেশনে। টোকিও স্টেশনের জন্য বুলেট ট্রেনের দুটি ডিজিটাল টিকেট হাতে দিয়ে হিকারি বললেন, যে ট্রেন আগে আসবে সেটাই চড়বো।
ট্রেন দুটির নাম শুনে ভিমরি খেলাম, কোদামা এক্সপ্রেস ও হিকারি এক্সপ্রেস। আমাদের গাইড তো ভাগ্যবান দেখি, খোদ দেশের রাজধানীতে তার নামে বুলেট ট্রেন আছে! হিকারির দিকে টিকেটটা নাড়ির অনুভূতি জানালাম। মুচকি হেসে প্লাটফরমের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি।
মনে আশা জাগলো হিকারি এক্সপ্রেসটাই যেন আগে আসে। দুর্ভাগ্য টোকিও যাত্রার সঙ্গী হল কোদামা!
লেখক : আবদুর রহিম, বিপণন নির্বাহী ও গবেষক