অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের হাতিয়ার পর্যটনশিল্প
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন শিল্পে যখন মন্দা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তখনই সারা বিশ্বে অতি দ্রুত সম্প্রসারণশীল ও বহুমাত্রিক শিল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে পর্যটনশিল্পের। এই শিল্প শুধু আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বহন করে না, সেই সঙ্গে টেকসই উন্নয়নের অগ্রগতিকে সচল রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই পৃথিবীর প্রায় সকল দেশে পর্যটন এখন অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার খাত। ১০৯টি শিল্পের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত পর্যটন বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের হাতিয়ার।
২০১৭ সালে বিশ্বের জিডিপিতে ট্যুরিজমের অবদান ছিল ১০.৪ শতাংশ যা ২০২৭ সালে ১১.৭ শতাংশে গিয়ে পৌঁছাবে। এছাড়া ২০১৭ সালে পর্যটকদের ভ্রমণখাতে ব্যয় হয়েছে ১৮৯৪.২ বিলিয়ন ডলার। আর একই বছর পর্যটনে বিনিয়োগ হয়েছে ৮৮২.৪ বিলিয়ন ডলার। পর্যটনকে বলা হয় একটি শ্রমবহুল ও কর্মসংস্থান তৈরির অন্যতম হাতিয়ার। বর্তমানে পৃথিবীর ১০টি কর্মসংস্থান খাতের মধ্যে ১টি হলো পর্যটন খাত। ২০১৭ সালে প্রায় ১১ কোটি ৮৪ লাখ ৫৪ হাজার কর্মসংস্থান তৈরি হয় পর্যটন খাতে। যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ খাত মিলিয়ে প্রায় ৩১ কোটি ৩২ লাখ। অর্থাত্ মোট কর্মসংস্থানের ৯.৯ শতাংশ তৈরি হয় পর্যটন খাতে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের জিডিপি খাতে পর্যটন শিল্পের মোট অবদান ছিল ৮৫০.৭ মিলিয়ন টাকা। আর এইখাতে কর্মস্থান তৈরি হয়েছে মোট ২৪ লাখ ৩২ হাজারটি। সুতরাং এই পরিসংখ্যান থেকে বুঝা যায় আমাদের দেশ পর্যটন শিল্প কতটা পিছিয়ে আছে।
বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে পণ্যের বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন সাধন করাই হলো পর্যটন শিল্পের মূল বিষয়। বিগত বছরগুলোয় বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে পর্যটন শিল্পের আবির্ভাব ঘটেছে। নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন ও টেকসই উন্নয়ন সাধনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে পর্যটন শিল্প। পর্যটন শিল্প সমৃদ্ধ উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালেই এ সত্য উপলব্ধি করা যায়।
বিশ্ববাণিজ্যের ক্ষেত্রে অবদান রাখছে শতকরা ৬ ভাগ যার পরিমাণ ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার। জানা গেছে, ভ্রমণপিপাসু পর্যটকরা প্রতিবছর থাকা, খাওয়া, ভ্রমণ, দর্শন এবং কেনাকাটা বাবদ খরচ করেন প্রায় ৫০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। আরো জানা গেছে, বিশ্বের প্রায় ৮৩ ভাগ দেশের সবচেয়ে জাতীয় আয় আহরণকারী প্রথম পাঁচটি খাতের মধ্যে পর্যটন একটি বিশেষ খাত। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, পর্যটকরা এখন পুরাকীর্তি, বাগান, পাহাড়, সাগর, ঝরনার পাশাপাশি ইকো ট্যুরিজমের দিকে ঝুঁকছে। প্রকৃতির পাশাপাশি মানুষের বিচিত্র জীবনধারা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিও পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়ছে।
পর্যটন শিল্প বিকাশের অবারিত সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশে। আশার খবর হচ্ছে, এখন প্রতি বছর ৫০ থেকে ৬০ লাখ দেশীয় পর্যটক বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ভ্রমনে যায়। পাঁচ বছর আগে এ সংখ্যা ছিল ২৫ থেকে ৩০ লাখ। ২০০০ সালের দিকে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ থেকে ৫ লাখ। বিদেশি পর্যটক নির্ভরতা ছাড়াও দেশীয় পর্যটকদের নিরাপত্তা, যোগাযোগ সুবিধা, আকর্ষণীয় অফার এবং পর্যটন ব্যয় সীমার মধ্যে থাকলে দেশের মানুষ আগ্রহ নিয়ে দেশ ঘুরে দেখতে চাইবে। এক হিসেবে বলা হয়, ১৬ কোটির বেশি মানুষের বাংলাদেশ গড়ে প্রতিবছরে ১০ ভাগও যদি দেশ ঘুরে দেখে তাহলে বিশাল অঙ্কের অর্থনৈতিক তত্পরতা সৃষ্টি হবে। দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন ঘটছে পর্যটন শিল্প বিকাশের ফলে।
বিভিন্ন পরিসংখ্যানের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে জানা গেছে,পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত হোটেল ব্যবসা, রেস্তোরাঁ ব্যবসা, পরিবহনসহ বিনোদন খাত থেকে এ আয় হচ্ছে। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী সমগ্র বিশ্বে ২০২০ সাল নাগাদ পর্যটন থেকে প্রতিবছর ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হবে। ২০৫০ সাল নাগাদ ৫১টি দেশের পর্যটক আমাদের দেশে আসবে। বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১০ শতাংশ এই পর্যটন খাত থেকে আয় করা সম্ভব। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল এ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের মতে, ২০১৩ সালে পর্যটন খাতে ১৩ লাখ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এই খাতে ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ২ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। যদি তা সম্ভব হয়, তাহলে ২০২৪ সালে মোট কর্মসংস্থানের মধ্যে পর্যটন খাতের অবদান দাঁড়াবে ১ দশমিক ৯ শতাংশ।
অন্যদিকে এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন করে বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ ও অনুকূল সুবিধা সৃষ্টি করতে পারলে বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার থেকে বছরে কমপক্ষে ২০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় করা সম্ভব। ডব্লিউটিটিসির গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে এ মুহূর্তে ১১ লাখ ৩৮ হাজার ৫০০ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পর্যটন খাতে সম্পৃক্ত। পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশকে সারা বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল কয়েকটি পর্যটন কেন্দ্রের মধ্যে গণ্য করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের পর্যটন শিল্প বিকাশের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকলেও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় আমরা এই শিল্পের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সফল হতে পারিনি। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে, সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ, তাইওয়ানের ৬৫ শতাংশ, হংকং-এর ৫৫ শতাংশ, ফিলিপাইনের ৫০ শতাংশ, থাইল্যান্ডের ৩০ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে।
মালদ্বীপের অর্থনীতির বেশির ভাগই আসে পর্যটন খাত থেকে। এছাড়া মালয়েশিয়ার বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ৭ শতাংশই আসে পর্যটন খাত থেকে। অথচ ওয়ার্ল্ড ট্রেড অ্যান্ড ট্যুরিজম করপোরেশনের তথ্যমতে, ২০০৯ সালে বাংলাদেশের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ছিল মাত্র ৩.৯ ভাগ। ২০২০ সাল নাগাদ এর পরিমাণ বেড়ে ৪.১ ভাগ হবে বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। আবার বাংলাদেশ বর্তমানে এই খাত থেকে যেখানে প্রায় ৭৬.১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বার্ষিক আয় করে সেখানে সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশগুলোর পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায়, ভারতে পর্যটন খাত থেকে আয়ের পরিমাণ ১০,৭২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, মালদ্বীপে ৬০২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, শ্রীলঙ্কায় ৩৮৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, পাকিস্তানে ২৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং নেপালে এর পরিমাণ ১৯৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে যুগে যুগে বহু পরিব্রাজক এবং ভ্রমণকারী মুগ্ধ হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে এ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন-সম্ভাবনা অপরিসীম। আমাদের রয়েছে সুবিশাল সমুদ্র সৈকত, পাহাড়, অরণ্যঘেরা জলপ্রপাত, প্রত্নতত্ত্বের প্রাচুর্য, ঐতিহাসিক নিদর্শনসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত স্থান, যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি আমাদের দেশকে পরিণত করেছে একটি বহুমাত্রিক আকর্ষণসমৃদ্ধ অনন্য পর্যটন গন্তব্যে, যা বাংলাদেশকে গড়ে তুলেছে পর্যটকদের জন্য তীর্থস্থান হিসেবে।
আমাদের দেশে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার রয়েছে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন রয়েছে, রয়েছে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত যেখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়। শৈবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন, রামুর বৌদ্ধ মন্দির, হিমছড়ির ঝরনা, ইনানী সমুদ্র সৈকত, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ, টাঙ্গুয়ার হাওর, টেকনাফ সহজেই পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সবুজ পাহাড়ি অঞ্চল দেখে কেউ কেউ আত্মভোলা হয়ে যায়। আবার আমাদের দেশে অনেক ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানও রয়েছে। বগুড়ার মহাস্থানগড়, নওগাঁর পাহাড়পুর, দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, ঢাকার লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, বাগেরহাটের ষাট গম্বু্বুজ মসজিদ, খান জাহান আলীর মাজার, রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘর, কুষ্টিয়ার লালন সাঁইয়ের মাজার, রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি শুধু দেশীয় নয়, বরং বিদেশি পর্যটক ও দর্শনার্থীদের কাছেও সমান জনপ্রিয় এবং সমাদৃত।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিসেবে সুপরিচিত বাংলাদেশে রয়েছে একাধিক পর্যটন কেন্দ্র। এছাড়া রয়েছে সম্ভাবনাময় আরো বহু পর্যটনবিধৌত স্থান। সময়োপযোগী ও পরিকল্পনামাফিক পদক্ষেপ গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে এসব পর্যটন স্পট যদি পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা যায়, তাহলে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে নবদিগন্তের সূচনা হবে। কিন্তু পর্যটন বলতে শুধু ঘোরাফেরার ধারণা পরিবর্তন করে একে বহুমুখী করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। পর্যটনের বহু শাখা-প্রশাখার মধ্যে বিনোদন পর্যটন, শ্রান্তি বিনোদন পর্যটন, স্বাস্থ্য পর্যটন, শিক্ষা পর্যটন, সাংস্কৃতিক পর্যটন, ইভেন্ট পর্যটন এবং মাইস (MICE) পর্যটনের বাইরেও ইকো পর্যটন, কৃষিভিত্তিক পর্যটন, শিল্পভিত্তিক পর্যটন, সংস্কৃতিভিত্তিক পর্যটন, ক্রীড়া পর্যটন, নৌ-পর্যটন, হাওর পর্যটন, ধর্মভিত্তিক পর্যটনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এত সম্ভাবনা থাকার পরেও আমরা পর্যটক আকৃষ্ট করবার মতো কর্মপন্থাই এখনো নির্ধারণ করে উঠতে পারছি না। আমরা একটু সচেতন হলেই নিজেদের পর্যটন সক্ষমতা বাড়িয়ে বিপুলসংখ্যক বিদেশি দর্শনার্থীকে নিজের দেশে আনতে পারি। আধুনিক জীবনের চাওয়াকে মাথায় রেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে আমাদের পর্যটন শিল্পের বিকাশ সাধনে সচেষ্ট হতে পারি।
অপরূপ বাংলাদেশটাকেও বিশ্ব মানুষ তাদের অবকাশযাপনের ঠিকানা হিসেবে ভাববে, যদি আমরা মেধাবী ও যোগ্য মানুষদের ঠিক জায়গায় বসাতে পারি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিসেবে সুপরিচিত বাংলাদেশে রয়েছে একাধিক পর্যটন কেন্দ্র। এছাড়া রয়েছে সম্ভাবনাময় আরো বহু পর্যটনবিধৌত স্থান। সময়োপযোগী ও পরিকল্পনামাফিক পদক্ষেপ গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে এসব পর্যটন স্পট যদি পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা যায়, তাহলে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে নবদিগন্তের সূচনা হবে। তবে পর্যটন বলতে শুধু ঘোরাফেরার ধারণা পরিবর্তন করে একে বহুমুখী করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। যাতে এই দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সাধিত হয়।
লেখক : ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভুঁইয়া, চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।