অরলি বিমানবন্দরে ইঁদুর-বিড়াল খেলা!

অরলি বিমানবন্দর। ফ্রান্সের দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর। রাজধানী প্যারিসের ১৩ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত বিমানবন্দরটি আংশিকভাবে অরলিতে এবং আংশিকভাবে ভিলেনিউভে-লে-রোয়িতে অবস্থিত। চার্লস ডি গল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (সিডিজি) চালুর আগে অরলি ছিল প্যারিসের প্রধান বিমানবন্দর। এমনকি বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক ট্র্যাফিক সিডিজি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্থানান্তরিত হওয়া সত্ত্বেও, অরলি স্থানীয় ট্র্যাফিকের জন্য সবচেয়ে ব্যস্ততম ফরাসি বিমানবন্দর এবং যাত্রীবাহী বোর্ডিংয়ের ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে দ্বিতীয় ব্যস্ত ফ্রেঞ্চ বিমানবন্দর হিসাবে রয়ে গেছে। ইউরোপের দ্বাদশতম ব্যস্ততম বিমানবন্দর হিসাবে ২০১৮ সালে ৩৩ মিলিয়নেরও বেশি যাত্রী বিমানবন্দরটি ব্যবহার করেন।

উড়োজাহাজ আর যাত্রীকে নিয়ে ব্যস্ততার চেয়ে মাদক পাচারকারীদের নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতে হয় বিমানবন্দের কাস্টমস কর্মকর্তাদের। অরলি বিমানবন্দরের কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলে এই মাদক পাচারকারীদের। বাস্তব গল্প নিয়েই এই প্রতিবেদন। নিরাপত্তার স্বার্থে মাদক পাচারকারীদের রেখে পরিচয় গোপন ছদ্মনাম ব্যবহার করা হল।

দক্ষিণ আমেরিকার ফ্রেঞ্চ গায়ানা থেকে প্রতিদিন আসেন তাঁরা। লাগেজে বা পেটে থাকে কোকেন। লুকোচুরি খেলায় কেউ ধরা পড়েন, কেউ পড়েন না। এ কাজে ঝুঁকি অনেক বেশি। তবে হারানোর মতো তেমন কিছু তো নেই এই ছিঁচকে মাদক পাচারকারীদের।

পুলিশি প্রহরায় অর্লি বিমানবন্দর।
পুলিশি প্রহরায় অর্লি বিমানবন্দর।

ফ্রেঞ্চ গায়ানার রাজধানী কায়ানে থেকে অরলি রুটে প্রতিদিন দুটি ফ্লাইট আসে। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ফ্রান্সে কোকেন পাচার করার সবচেয়ে জনপ্রিয় রুটে পরিণত হয়েছে এই আকাশপথ।

প্যারিসে আসার সময় অরলি বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার হন হেনরিটা। কাস্টম অফিসে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছেন ৩১ বছর বয়সের এই যুবক। হাত ভাঁজ করে, মাথা ঝুলিয়ে, নির্লিপ্ত হয়ে বসে আছেন। পাশে রাখা বিশাল একটি গোলাপি স্যুটকেস, যেটাতে স্ক্যান করে পাওয়া গেছে সন্দেহজনক কিছু জিনিস ।

Travelion – Mobile

সেখানকার এক এজেন্ট মামলা করেন। জিজ্ঞাসাবাদের শুরুতে এজেন্ট বলেন, এখানে কেবল টি–শার্ট আছে। ওখানে তো ম্যাডাম শরৎ চলছে।

তবে কালো টি–শার্ট পরা হেনরিটা এ কথার কোনো জবাব দেন না। ফরাসি ভাষায় একটি শব্দও জানেন না তিনি। কেবল গায়ানায় ব্যবহৃত স্থানীয় কিছু ফ্রেঞ্চ শব্দ ব্যবহার করেন। হেনরিটার স্যুটকেস থেকে এশিয়া অঞ্চলের বের করে আনেন এজেন্ট।

ইট আকৃতির পার্সেল খুলে কালোরঙা শৈবাল সরিয়ে গাঁজা উদ্ধার করা এজেন্ট বলেন, ব্যাপারটা খুব একটা জটিল নয়। সমস্যা একটাই, প্যাকেটের গাঁজার ওজন আট কেজির ওপরে।

লাগেজ ট্রলি ঠেলে নিয়ে যাওয়ার সময় হাত কাঁপছিল হেনরিটার। তাই দেখে সন্দেহ হয় কর্মকর্তাদের। সেই সন্দেহের জেরে উদ্ধার করা হয় এত গাঁজা।

ঊরুতে টেপ দিয়ে আটকে বা পায়ুপথে ঢুকিয়ে কোকেন বহন করে অনেক পাচারকারী
ঊরুতে টেপ দিয়ে আটকে বা পায়ুপথে ঢুকিয়ে কোকেন বহন করে অনেক পাচারকারী

রোবটের মতো হাঁটার জন্য ২১ বছর বয়সী জ্যঁ পিয়েরেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সাধারণত যাঁরা ঊরুতে টেপ দিয়ে আটকে বা পায়ুপথে ঢুকিয়ে কোকেন বহন করেন, তাঁদের হাঁটার ভঙ্গি এমন হয়।

বিমানবন্দরের কাস্টমস কর্মকর্তা অলিভার গর্ডন বলেন, অনেকে শীতের দিনেও হাফপ্যান্ট পরে আসেন। কোন টানে বিমানবন্দরে আসছেন, তা–ও ঠিক করে জানেন না তাঁরা। জিজ্ঞেস করলে জানান, সাত শ কিলোমিটার দূরে টলোজে যাচ্ছেন, তা–ও নাকি ট্যাক্সিতে করে!

গর্ডন জানান, প্রতি ফ্লাইটে গড়ে ৮ থেকে ১০ জন চোরাচালানকারী যাতায়াত করেন। মাদক গ্যাংগুলো কাস্টমস কর্মকর্তাদের সহ্যের সীমা অতিক্রম করার চেষ্টা করছে। এর জেরে বেশ কিছু চোরাচালানকারী বলির শিকারও হন।

টালমাটাল অবস্থায় থাকা এসব পাচারকারীর হাতে একটি লাগেজ ধরিয়ে দেওয়া হয়। যেভাবে তাঁরা ছদ্মবেশ নেন, তা ধরে ফেলা খুব সোজা।

কখনো কখনো কাস্টমস কর্মকর্তাদের বিভ্রান্ত করতে বেনামি সব কল আসতে থাকে। এত শত ঝামেলা পেরিয়েও জ্যঁ পিয়েরে বা হেনরিটাদের কাছ থেকে আট কেজি কোকেন পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।

পাকস্থলীতে করে মাদকদ্রব্য পাচার করেন চোরাকারবারিরা
পাকস্থলীতে করে মাদকদ্রব্য পাচার করেন চোরাকারবারিরা

মাঝেমধ্যে পাকস্থলীতে করে মাদকদ্রব্য পাচার করেন চোরাকারবারিরা। ধরা পড়লে বিমানবন্দরের পাশের একটি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে অপারেশনের মাধ্যমে পেট থেকে মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়। চিকিৎসক, পুলিশ ও আইনজীবীদের তত্ত্বাবধানে হাসপাতালটিতে এ কাজের জন্য নয়টি কক্ষ সংরক্ষিত আছে।

তিন দিনের চেষ্টায় সিলভেইন (২৬) নামের এক চোরাচালানকারীর পেট থেকে কোকেনের ৪৯টি প্যাকেট উদ্ধার করা হয়।

আজকালকার চোরাচালানকারীরা প্রযুক্তির দিক থেকে অনেক এগিয়ে গেছেন। যে প্যাকেটে মুড়িয়ে তাঁরা কোকেন গিলে ফেলেন, তার উপাদানেও এসেছে ভিন্নতা। হাসপাতালের মেডিকেল জুডিশিয়াল বিভাগের প্রধান নিকোলাস সৌসি বলেন, কোকেনের মোড়ক ফেটে গত ১০ বছরে ফ্রান্সে অন্তত দুজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা নারীও মাদক পাচারের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। দুই বছরের সাজা পাওয়া এই নারীর সন্তান জন্ম নেবে কারাগারেই। প্রতিদিন এমন অসংখ্য পাচারকারীকে সামলাতে গিয়ে প্যারিসের অর্লি বিমানবন্দরের কাস্টমস কর্মকর্তাদের তো বটেই, পুলিশকেও কম হ্যাপা পোহাতে হচ্ছে না।

পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছর গায়ানার ১ হাজার ৩৪৯ জন পাচারকারীকে আটক করা হয়। ২০১৭ সালের তুলনায় এ সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!