অভিনব প্রযুক্তিতেই করোনা-রোধ করছে দক্ষিণ কোরিয়া

ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে এবং মার্চের গোড়ার দিকে, দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনভাইরাস সংক্রমণের সংখ্যা কয়েক ডজন থেকে কয়েক শতাধিক হয়ে কয়েক হাজারে দাঁড়িয়েছিল। চূড়ান্ত পর্যায়ে, চিকিত্সা কর্মীরা ২৯ ফেব্রুয়ারি, একদিনে ৯০৯ জন করোনাভাইরাস আক্রান্ত শনাক্ত করেছিলেন এবং ৫ কোটি ১০ লাখ জনগোষ্টির দেশটি মহাবিপদের দ্বারপ্রান্ত উপস্থিত হয়েছিল। তবে এক সপ্তাহেরও কম পরে, আক্রান্তের সংখ্যা অর্ধেক হয়ে যায়। চার দিনের মধ্যে, এটি আবার অর্ধেক হয়ে যায় – এবং পরের দিন আবার।

প্রায় এক মাসের কম সময়ের মধ্যে কোরিয়ায় কমতে শুরু করে আক্রান্তের সংখ্যা, যেখানে উন্নত বিশ্বের দেশগুলিতে সংক্রমণ প্রতিদিন হাজারেও বেড়েই চলেছে, লেগেছে মৃত্যুর মিছিল, বিধ্বস্ত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা। বৃস্পতিবারের সবশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনাভাইরাসের ৯ হাজার ৯৭৬ জন আক্রান্ত, ৫ হাজার ৮২৮ জন সুস্থ এবং ১৬৯ জন মারা গেছেন।

চীনের পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়া হল বড় প্রাদুর্ভাবের সেই দেশ যারা নতুন সংক্রমণ রোধ করতে সক্ষম হয়েছে এবং তা চীনের মতো বাক শক্তি স্তব্দ এবং চলাফেরায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ ছাড়া বা ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যেপ্রাচ্যের মতো অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিকারক লকডাউনে না গিয়ে সম্ভব করেছে ।

Travelion – Mobile

মূলত: প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থাই দক্ষিণ কোরিয়ার পেছনে অন্যতম নিয়ামক শক্তি ছিল। গোটা বিশ্বের প্রযুক্তির অন্যতম দেশ কোরিয়া, প্রতিটি সেক্টরে প্রযুক্তির ছোঁয়া, বলা চলে দক্ষিণ কোরিয়া প্রযুক্তি নজরদারির দেশ। কোরিয়ার হাসপাতাল, ক্লিনিকগুলোতে ডাক্তার, নার্সদের সুরক্ষা দিতে করোনা টেস্টিং বুথ বসানো হয়েছে। যাতে ডাক্তার ও নার্সরা বিপদমুক্ত থাকে।

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে  দক্ষিণ কোরিয়ার প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থা
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থা

দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতিদিন প্রায় ২০,০০০ লোকের করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা হচ্ছে, বিশ্বের কোথাও, কোন দেশে একদিনে এত সংখ্যক টেষ্ট করা হচ্ছে না। কোরিয়া এই পর্যন্ত ৩ লাখ ৮০ হাজার মত ব্যক্তির টেষ্ট করিয়েছে।

সংক্রামক নিয়ন্ত্রণের যুদ্ধে, এই ল্যাবগুলি সামনের লাইনে পরিণত হয়েছে। করোনাভাইরাস পরীক্ষা করার জন্য দক্ষিণ কোরিয়া ৯৬ টি সরকারী এবং বেসরকারী পরীক্ষাগারগুলির একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। তাছাড়া ৬০টিরও ওপর ভ্রাম্যমাণ ল্যাবরেটরী স্থাপন করেছে। নতুন সংযোজন করেছে বুথ টেষ্টিং সিস্টেম।

স্বাস্থ্য বিশারদরা বিশ্বাস করেন যে, এই পদ্ধতির জীবন বাঁচাতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনাভাইরাসের মৃত্যুর হার ০.৭%। বিশ্বব্যাপী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রিপোর্টে বলছে কোরিয়ার টেষ্ট পদ্ধতি, করোনা মোকাবিলায় দক্ষতা দেখিয়েছে।

দক্ষিণ কোরিয়া অন্য কোনও দেশের তুলনায় করোনাভাইরাসের জন্য অনেক বেশি লোককে পরীক্ষা করেছে, সংক্রামিত হওয়ার সাথে সাথেই বহু লোককে বিচ্ছিন্ন ও চিকিৎসা করতে সক্ষম হয়েছে। কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ৪০ গুণ বেশি পরীক্ষা করেছে।

কোরিয়া টেষ্টকে বেশি প্রাধাণ্যে দিয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে অভিনব সব ব্যবস্থা ও প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে তারা। হাসপাতালগুলি এবং ক্লিনিকগুলিকে ৬০০০০ টি পরীক্ষামূলক কেন্দ্র খোলেন-এবং যোগাযোগকে হ্রাস করে স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপদে রাখেন।

প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) ব্যবহার করে সহজ ও সফলভাবে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করছে দেশটির স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো। ৫০টি ড্রাইভ-থ্রি স্টেশন খোলেন, যেখানে রোগীদের পরীক্ষা করা হচ্ছে নিয়মিত। দূরবর্তী তাপমাত্রা স্ক্যান দিয়ে রোগীদের দেখা হচ্ছে। এতে প্রক্রিয়াটি শেষ হতে প্রায় ১০ মিনিট সময় নেয়। পরীক্ষার ফলাফল কয়েক ঘন্টার মধ্যে দেয়া হচ্ছে।

কিছু ওয়াক-ইন সেন্টারে রোগীরা স্বচ্ছ ফোন বুথের সদৃশ একটি কক্ষে প্রবেশ করেন। স্বাস্থ্যকর্মীরা চেম্বারের দেওয়ালে অন্তর্নির্মিত ঘন রাবারের গ্লাভস ব্যবহার করে রোগীদের পরীক্ষা করছেন।

দ্য কোরিয়া হেরাল্ডের প্রতিবেদনে বুশান অঞ্চলের একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং রাজধানী সিউলের বোরামেই মেডিকেল সেন্টারে করোনা পরীক্ষার জন্য এ ধরনের বুথ চালুর বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্লাভযুক্ত স্বচ্ছ কাচের দেয়াল বুথের ভেতর থেকে স্বাস্থ্য কর্মীরা নমুনা সংগ্রহ করছেন। তাই, তাদের কোনো প্রকার ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের (পিপিই) প্রয়োজন হচ্ছে না।

বুথের নিচে চার কোণায় চারটি চাকা বসানো হয়েছে। জীবাণুমুক্ত করার জন্য বুথগুলোকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়। আবার কোনো রোগীর নমুনা পরীক্ষার জন্য অন্য জায়গায় যাওয়ার প্রয়োজন হলে সেখানেও তুলে নিয়ে যাওয়া যায়। বুথগুলো গ্লাভসসহ জীবাণুমুক্ত করতে ৫-১০ মিনিট সময় লাগে।

বুথের উদ্ভাবক বুশান অঞ্চলের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ৪১ বছর বয়সী ডা. আহ্ন ইয়ো হ্যুন বলেন,‘স্বাস্থ্যকর্মীদের পিপিইর প্রয়োজন নেই। কারণ তারা বুথের ভেতরে থাকবেন। বুথের স্বচ্ছ কাঁচের দেয়ালে স্থায়ীভাবে গ্লাভস সংযুক্ত করা আছে। গ্লাভসে হাত ঢুকিয়ে ছিদ্র দিয়ে তারা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা রোগীর কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করবেন।’

তিনি আরও বলেন, এই ধরনের বুথ স্বাস্থ্যকর্মী ও রোগী উভয়কেই সুরক্ষিত রাখবে। স্বাস্থ্যকর্মীরা নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারবেন। এই বুথ একদিকে যেমন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে, অন্যদিকে পরিবেশ দূষণও কমায়।

“অনেকক্ষেত্রে একটি পিপিই একবারের বেশি ব্যবহার করা যায় না। ফলে, বিপুল পরিমাণ মেডিকেল বর্জ্য তৈরি হয় যেগুলো পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সবসময় পিপিই গায়ে দেওয়া, নিয়ম অনুযায়ী পরিবর্তন, সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অপসারণ করতে গিয়ে প্রচুর অর্থ ও সময়ের প্রয়োজন হয়”, তিনি যোগ করেন।

ডা. আহ্ন আরও জানান, ‘সারা শরীরে পিপিই পরার কিছুক্ষণের মধ্যেই দমবন্ধ লাগতে পারে। তার উপর গরম বাড়ছে। গরমের মধ্যে সারাক্ষণ এগুলো পরে থাকা খুবই কষ্টকর। অন্যদিকে এই বুথগুলো বায়ুরোধী—বাইরে থেকে বাতাস ঢুকতে পারে না, অর্থাৎ বাতাসের মাধ্যমে সংক্রমণেরও ভয় নেই।’

নিরলস পাবলিক মেসেজিংয়ের মাধ্যম দক্ষিণ কোরিয়ানদের যদি তারা বা তাদের পরিচিত কেউ বা বিদেশীদের করোনাভাইরাসের লক্ষণগুলি প্রকাশ পাই তাহলে পরীক্ষা করার জন্য অনুরোধ করছে । মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে রোগীর লক্ষণ, ভ্রমণের ইতিহাসসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্যও সংগ্রহ করা হচ্ছে। বিদেশ থেকে আগত দর্শনার্থীদের স্মার্টফোনে অ্যাপ্লিকেশন ডাউনলোড করতে হচ্ছে, যা করোনা ভাইরাসের লক্ষণগুলির জন্য স্ব-পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের গাইড করে।

করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়ার যুদ্ধ
করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়ার যুদ্ধ

স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব থাকলেও রোগ নির্ণয় যেন থেমে না থাকে সেজন্য রোবট তৈরি করেছে সিউলের অন্য একটি হাসপাতাল। স্বাস্থ্যকর্মীর সাময়িক অনুপস্থিতিতে রোগীর শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহের পাশাপাশি হাসপাতালটি জীবাণুমুক্ত করার জন্যও ব্যবহৃত হচ্ছে রোবট। ফলে, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের আর স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হচ্ছে না।

দক্ষিণ কোরিয়ার সর্বোচ্চ আক্রান্ত অঞ্চল দেইগুতে রোগীরা সরাসরি চিকিৎসকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলতে পারেন। রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী কাছাকাছি ফার্মেসি থেকে তাদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়, ডিজিটাল পদ্ধতিতে ওষুধের ব্যবস্থাপত্র লিখা হয়।

আগের খবর
করোনাজয়ী দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে ১২১ দেশের ধরনা
হে বিশ্ব, কোরিয়া থেকে শেখো ‘করোনা যুদ্ধ’ জয়ের মন্ত্র
দক্ষিণ কোরিয়ার করোনা-কৌশল অনুসরণে জার্মানির সাফল্য

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!