অবশেষে খোঁজ মিলল করোনাভাইরাসের ‘পেশেন্ট জিরো’

করোনাভাইরাস প্রাদূর্ভাবের পর থেকেই চীনসহ সারাবিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা যাকে হন্য খুঁজছিলেন তিনি হলেন এই ভাইরাসের ‘পেশেন্ট জিরো’ মানে প্রথম আক্রান্ত রোগী। কারন নতুন সংক্রামক অসুখের ক্ষেত্রেআক্রান্ত প্রথম ব্যক্তিটিকে চিহ্নিত করা খুবই জরুরি বলে মনে করেন চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা। তাঁকে ভালভাবে স্টাডি করলে, কেন, কীভাবে এবং কোথায় এই সংক্রমণের সূচনা হয়েছিল, তা জানা সহজ হয়, বের হয় প্রতিরোধের উপায়, ভ্যাসকিন। চিকিৎসা পরিভাষায় এই রোগীদের বলা হয়, ‘পেশেন্ট জিরো’ বা ‘ইনডেক্স কেস’। তাই করোনার বিরুদ্ধে লড়তে লড়তেই চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা খুজছিলেন, করোনাভাইরাসের ‘পেশেন্ট জিরো’কে।

অবশেষে সেই ‘পেশেন্ট জিরো’র সন্ধান মিলেছে। তিনি ৫৭ বছর বয়সী এক চীনা মহিলা। নাম ওয়েই গুইশিয়ান। চীনের উহান শহরের বাজারে চিংড়ি মাছ বিক্রি করতেন। বিশ্বে তিনিই প্রথম কোভিড ১৯ (করােনাভাইরাস) রোগে আক্রান্ত হন,এমনটাই এখন দাবি করা হচ্ছে।

আমেরিকার ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, ওয়েই গুয়েইশিন গত ১০ ডিসেম্বর হুনান সি ফুড মার্কেটে চিংড়ি বিক্রি করার সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রথমে ভেবেছিলেন, ঠান্ডা লেগেছে। ফ্লুর মতো কোনও রোগ হয়েছে। তিনি স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়েছিলেন। সেখানে তাকে ইঞ্জেকশান দিয়েছিল। কিন্তু তাতে রোগ সারেনি। বরং তিনি খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। তার ধারণা হয়েছিল, ফ্লু নয়, আরও গুরুতর কোনও রোগে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি।

Travelion – Mobile

একদিন পরে ওয়েই গিয়েছিলেন উহানের ইলেভেন্থ হাসপাতালে। এর পরেও তার দুর্বলতা কমেনি। ১৬ ডিসেম্বর তিনি যান উহান ইউনিয়ন হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে দেখেন, সি ফুড মার্কেট থেকে আরও অনেকে এসেছেন। তাদের প্রত্যেকের শরীরে তার মতোই রোগের লক্ষণ ফুটে উঠেছে।

চীনের এক সংবাদপত্রের রিপোর্টে জানা যায়, ডিসেম্বরের শেষে ওয়েই গুইশিয়ানকে কোয়ারান্টাইন করা হয়। ততদিনে সবাই জানতে পেরেছে করোনাভাইরাস আক্রমণ করেছে মানবজাতিকে।

প্রায় মাসখানেক হাসপাতালে চিকিৎসার পরে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। তিনি বলেন, ডাক্তাররা আমাকে জানিয়েছেন আমি জটিল রোগে আক্রান্ত হয়েছি। ওই সময় তার বড় মেয়ে সার্বক্ষণিকভাবে পাশেই ছিল এই ভেবে যে, মা না জানি কখন মারা যায়।

তিনি আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই তার পাশেই দোকান দেওয়া আরেকজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। এর পর একে একে করোনা-আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয় ওই বাজার সংশ্লিষ্ট আরও ২৫ জন। সেই যে শুরু তা আর থামেনি, রাজধানী উহান থেকে হুবেই প্রদেশ, অতঃপর সারা বিশ্ব।

সম্প্রতি ওয়েই গুইশিয়ান বলেছেন, চীনের সরকার যদি আরও আগে করোনাভাইরাসের বিপদটা বুঝতে পারত, তাহলে এই অতি মহামারি হত না।

মজার বিষয় হল, এইচআইভি (এইডস) মহামারী চলাকালীন ‘পেশেন্ট জিরো’ শব্দটি ভুলক্রমে তৈরি হয়েছিল। ৮০ এর দশকের গোড়ার দিকে লস অ্যাঞ্জেলেস এবং সান ফ্রান্সিসকোতে এই রোগের বিস্তার সম্পর্কে তদন্ত চলাকালীন, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধকেন্দ্রের (সিডিসি) গবেষকরা ইংরেজি “O” (ও) অক্ষরটি “ক্যালিফোর্নিয়ার রাজ্যের বাইরে” কাউকে উল্লেখ করার জন্য ব্যবহার করেছিলেন। অন্য গবেষকরা চিঠিটি ভুলভাবে একটি সংখ্যা’0’ (জিরো) হিসাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন -এবং তাই ‘পেশেন্ট জিরো’ ধারণার জন্ম হয়েছিল।

২০১৪ থেকে ২০১৬ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলায় মারা যায় ১১ হাজারেরও বেশি মানুষ, সংক্রমিত হন ২৮ হাজার। এই সংক্রামক অসুখে আক্রান্ত লোকের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল বিশ্বের ১০টি দেশে।

 ইবোলা ভাইরাসের  ‘পেশেন্ট জিরো’ গিনির মেলিয়ান্দো গ্রামের দু’বছর বয়সের সেই শিশু মা-বাবার সঙ্গে
ইবোলা ভাইরাসের ‘পেশেন্ট জিরো’ গিনির মেলিয়ান্দো গ্রামের দু’বছর বয়সের সেই শিশু মা-বাবার সঙ্গে

সে সময়ে বিজ্ঞানীরা নানা পরীক্ষা ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছেন যে, এই অসুখের উৎস ছিল গিনির মেলিয়ান্দো গ্রামের দু’বছর বয়সের একটি শিশু। খুব সম্ভবত বাদুড়ের ঝাঁক বাস করে এমন একটি গাছের কোটরে ঢুকে খেলতে গিয়েই সে সংক্রমিত হয়েছিল। তার পরে তার থেকে ছড়িয়ে পড়ে এই মরণ অসুখ।

অনেক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ প্রাদুর্ভাবের প্রথম নথিভুক্ত কেস মানে ‘পেশেন্ট জিরো’ শনাক্তকরণের বিরোধী, কারণ এই রোগের বিচ্ছিন্নতা বা এমনকি প্রথম ব্যক্তিটি শিকার হওয়ার কারণ হতে পারে। একটি বিখ্যাত উদাহরণ হ’ল একজন ব্যক্তি যিনি ভুলভাবে এইডস মহামারীর “পেশেন্ট জিরো” হিসাবে চিহ্নিত হন।

কানাডার সমকামী ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট গায়তন দুগাস ইতিহাসের অন্যতম ঘাতক রোগী ছিলেন, তাকে ১৯৮০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এইচআইভি-এইডস ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য দায়ী করা হয়েছিল। কিন্তু তিন দশক পরে, বিজ্ঞানীরা প্রকাশ করেছিলেন যে, তিনি প্রথম কেস হতে পারেন না-২০১৬ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ১৯৭০ এর দশকের শুরুতে ভাইরাসটি ক্যারিবিয়ান থেকে আমেরিকা চলে আসে।

তবে সম্ভবত সবচেয়ে পরিচিত “পেশেন্ট জিরো” হলেন মেরি ম্যালন, যিনি নিউ ইয়র্কে ১৯০৬ সালে টাইফয়েড জ্বরের প্রাদুর্ভাব ছড়ানোর জন্য ‘টাইফয়েড মেরি ‘নামে পরিচিতিপেয়েছিলেন।আয়ারল্যান্ডের অধিবাসী ম্যালন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ধনী পরিবারে রান্নাঘরে কাজ করতেন। নিউইয়র্কের ধনী পরিবারগুলির মধ্যে টাইফয়েড প্রাদুর্ভাবের পরে, ডাক্তাররা ম্যালনকে “পেশেন্ট জিরো” হিসেবে শনাক্ত করেছিলেন। তিনি যেখানেই কাজ করেছেন, পরিবারের সদস্যরা টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন।

এখন প্রমাণিত সত্য যে কিছু লোক ভাইরাস ছড়ানোর ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে বেশি “দক্ষ” এবং ম্যালন প্রথম দিকের রেকর্ড হওয়া “ক্ষমতা” থাকা একজন ব্যক্তি যিনি “সুপার-স্প্রেডার” হিসাবে পরিচিত পেয়েছিলেন। ওই সময় নিউ ইয়র্ককে এই রোগে বছরে কয়েক হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল এবং এতে মৃত্যুের হার ছিল ১০% ।

আগের খবর
কে সেই ‘পেশেন্ট জিরো’, যাকে পেলে রুখতে পারে করোনা?

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!