মৃত্যুর আগে সৌদিপ্রবাসী স্বামীকে ফিরিয়ে দেওয়ার আকুতি স্ত্রীর
স্ট্রোক করে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে সৌদি আরবের একটি হাসপাতালে পড়ে আছেন মিজানুর রহমান(৬২)। তাঁকে দ্রুত দেশে ফেরানোর আকুতি নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তাঁর স্ত্রী নাসরিন আক্তার। ১৯৯৩ সাল থেকে সৌদি আরবে কাজ করছেন প্রবাসী মিজান। সবশেষ দেশে এসেছিলেন ২০১৫ সালে। এখন তিনি দেশে ফিরতে চান, কিন্তু ফিরতে পারছেন না। নিজ থেকে ফেরার অবস্থা তাঁর নেই।
মিজানুরের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী। তিনি সৌদির জুবাইল এলাকায় থাকেন। সেখানে দিনমজুর হিসেবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজ করে আসছিলেন তিনি।
স্ত্রী নাসরিন সাংবাদিকদের বলেন, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি স্ট্রোক করা পর পরিচিত প্রবাসী বাংলাদেশিরা আমার স্বামীকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এখন তিনি সেখানকার জুবাইল জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। তাঁর অবস্থা ভালো নয়। তিনি এখন ঠিকমতো চিকিৎসা পাচ্ছেন না।”
স্বামীকে ফেরাতে নাসরিন সৌদির বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করেন। দূতাবাস জানায়, অবৈধ কর্মী সংক্রান্ত মামলার সমাধান হলে তারা মিজানুরকে দ্রুত দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে। মামলার ব্যাপারেও সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেয় রিয়াদ দূতাবাস। পরে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির (মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম) সহায়তায় সরকারের ওয়েজ আর্নাস কল্যাণ বোর্ডে আবেদন করেন তিনি। এখন কল্যাণ বোর্ডের সহায়তার অপেক্ষায় আছেন।
সৌদিতে, কফিলের (নিয়োগকর্তা) বাইরে কিংবা অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও কাজ করার কোনো সুযোগ প্রবাসী কর্মীর নেই। এর ব্যত্যয় হলে কর্মী অবৈধ হয়ে যান। এভাবে ২০১৭ সাল থেকে মিজানুর রহমান অবৈধ কর্মী হিসেবে সৌদিতে আছেন। তাঁর বিরুদ্ধে নিয়োগকর্তার ক্ষতিপূরণ মামলা আছে। নিয়োগকর্তা বেঁচে নেই, তবে মামলাটি রয়ে গেছে। শেষ কয়েক বছর মিজানুর নিয়মিত টাকাপয়সা পাঠাতে পারেননি। সংসার খরচের পাশাপাশি দুই সন্তানের লেখাপড়া চালিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছেন স্ত্রী নাসরিন।
নাসরিন বলেন, সৌদির বাংলাদেশ দূতাবাসে তাঁরা যোগাযোগ করেছেন। দূতাবাস বলেছে, মামলার সমাধান হলে তারা মিজানুরকে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে।
সৌদির হাসপাতালে পড়ে থাকা মিজানুরকে দেশে ফেরাতে ৯ এপ্রিল প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ওয়েজ আর্নাস কল্যাণ বোর্ডে আবেদন করেন নাসরিন। আবেদনে বলা হয়, ২৮ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ অসুস্থ (স্ট্রোক) হয়ে পড়েন মিজানুর। সৌদির রাষ্ট্রীয় জরুরি সেবা নম্বরে কল করার পর তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। যেহেতু তিনি অবৈধ, তাঁর আর্থিক অবস্থাও খারাপ, তাই তাঁর যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ তাঁকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনতে পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ করেন তিনি। একই আবেদন মন্ত্রণালয়েও করেছেন নাসরিন।
ওয়েজ আর্নাস কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক মো. গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া বলেন, মিজানুরকে দেশে ফিরিয়ে আনতে যা যা করণীয়, তা করা হবে। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
কল্যাণ বোর্ড সূত্র বলছে, প্রবাসী কর্মীদের মধ্যে যাঁরা অবৈধ, তাঁদের সরাসরি সহায়তা করতে পারে না এই সংস্থা। তাই তারা নাসরিনের আবেদনটি মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠিয়েছে।
১৬ এপ্রিল সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাসের লেবার উইংকে চিঠি দিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। সূত্র জানায়, চিঠিতে নাসরিনের আবেদন ও মিজানুরের সৌদির হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার কথা জানিয়ে বলা হয়, অসুস্থ এই প্রবাসীকে জরুরি ভিত্তিতে দেশে পাঠানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
মিজানুরের পরিবার বলছে, তিনি কয়েক বছর ধরে নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। নিয়মিত কাজ করতে পারছিলেন না। এবার স্ট্রোক করার পর প্রথম এক সপ্তাহ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ছিলেন। প্রথম সপ্তাহের হাসপাতাল বিল তিনি মওকুফ পেয়েছেন। কিন্তু বিলের নিশ্চয়তা না থাকায় পরে তাঁর চিকিৎসা তেমন চলছে না। এখন তিনি হাসপাতালের ওয়ার্ডে আছেন। তাঁর শরীরের এক পাশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত। তিনি সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকেন, তবে তিনি কথা বলতে পারছেন। তাঁর সঙ্গে পরিবারের কিছু কথা হয়েছে। মিজানুরের অডিও-ভিডিও বার্তা ছাড়াও অন্য প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে তাঁর অবস্থা সম্পর্কে পরিবার জানছে।
নাসরিন আরও বলেন, ‘ওখানে (সৌদির হাসপাতালের ওয়ার্ড) পড়ে থাকলে হয়তো মানুষটা মারা যাবে। পরিবারের কাছে ফিরলে মানুষটা বাঁচতেও পারে। দুই সন্তান বাবার ফেরার অপেক্ষায়। সরকার ও দূতাবাস চাইলেই একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারে। মানুষটা মারা গেলে দূতাবাস তাঁর মরদেহ দেশে পাঠাবে। আমি চাই, মৃত্যুর আগে আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দিন। না হলে সন্তাদের কাছে কী জবাব দেব? একটাই চাওয়া, সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নিক।’
সব খবর জানতে, এখানে ক্লিক করে আকাশযাত্রার ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে যুক্ত থাকার অনুরোধ