মিশরে বিশ্বনবীর জন্মদিনে ‘মিষ্টির পুতুল’ ঐতিহ্যের গল্প

মুসলিম দেশগুলি প্রতি বছর বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (স.)-এর জন্মদিন ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করে, তবে উদযাপনগুলি তাদের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি অনুসারে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভিন্ন হয়। অনেক মুসলমানের জন্য, উদযাপন একটি দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যার মাধ্যমে তারা নবীর প্রতি তাদের ভালবাসা প্রকাশ করে।

ফারাও সাম্রাজ্যের নানান সৃষ্টি, শিল্প নৈপূন্যে আর নীলনদের দেশ মিশরে, উদযাপনগুলি দেশের ইতিহাসের গভীরে প্রোথিত, আজ যে ঐতিহ্যগুলি বিদ্যমান তা প্রথম ফাতিমীয় যুগে চালু হয়েছিল; এর আগে, উদযাপনে শুধুমাত্র কুরআন পাঠ করা হতো। ফাতমিদের শাসনের পর থেকে, সর্বজনীন স্কোয়ারগুলি সজ্জিত করা, সুফি গানের জন্য তাঁবু স্থাপন এবং বিশেষ মোলিদ মিষ্টি তৈরি করা হয়।

মিশরে ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির পুতুল শিশু-বৃদ্ধ সবার অত্যন্ত প্রিয়। ছবি : সংগৃহীত
মিশরে ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির পুতুল শিশু-বৃদ্ধ সবার অত্যন্ত প্রিয়। ছবি : সংগৃহীত

মিশরে পবিত্র ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার পরই সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও জাতীয় উৎসব ঈদে মিলাদুন্নবী। মিষ্টি ভোজন প্রিয় মিশরীয়রা এই দিবসটিকে মোলিদ আল নাবী বা মোলিদ আল রাসুল (সা.) নামেই ডাকে।

মিশরীয়দের জন্য, নবীর জন্মদিন- মোলিদ আল নাবীর জন্য মিষ্টি তৈরি করা নবীর জন্মদিন -একটি ঐতিহ্য যা প্রজন্ম ধরে চলে আসছে। প্রতি বছর এই উপলক্ষে, সারাদেশের বেশিরভাগ মিষ্টির দোকানগুলি তাদের সমস্ত শক্তি উদযাপনের সঙ্গে যুক্ত বিশেষ মিষ্টি উত্পাদন এবং বিক্রিতে ব্যয় করে।

Travelion – Mobile

রবিউল আওয়াল মাস শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় রাজধানী কায়রোসহ সাড়া দেশের সুপার শপ থেকে শুরু করে পাড়া মহল্লার অলি গলির দোকানে মোলিদ মিষ্টির পসরা সাজানো হয়। এর মধ্যে ব্যতিক্রমী ঐতিহ্য হল ‘আরুসাত আল-মোলিদ’ বা জন্মদিনের পুতুল। মিষ্টির এই পুতুলগুলোকে রঙিন কাপড় দিয়ে নববধূ পোশাকের সাজে সজ্জিত করা হয়। এছাড়াও ঘোড় সওয়ারী, মসজিদ মিনারের মিষ্টির পুতুলও করা হয়।

ঈদে মিলাদুন্নবী (স.) উপলক্ষে মিশরে ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির পুতুল'আরুসাত আল-মোলিদ'। ছবি: সংগৃহীত
ঈদে মিলাদুন্নবী (স.) উপলক্ষে মিশরে ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির পুতুল’আরুসাত আল-মোলিদ’। ছবি: সংগৃহীত

মিশরে প্রথম মিলাদুন্নবী উদযাপনের প্রচলন শুরু হয় ফাতিমীয় খেলাফত (১০ থেকে -১২ শতক) যুগের সময় থেকে। জানা যায়, তৎকালিন শাসক গোষ্ঠী দরিদ্র ও অভাবী মানুষের জন্য বড় বড় ভোজনের আয়োজন করত এবং প্রচুর পরিমাণে হালাওয়েত আল-মোলিদ (মিষ্টি) বিতরণ করত।

‘আরুসাত আল-মোলিদ’ পুতুলগুলি ষষ্ঠ ফাতেমীয় শাসক খলিফা আল-হাকিম আল- আমরের সময় থেকে উদ্ভূত বলে মনে করা হয়। ঈদে মিলাদুনবীর দিন সুন্দরী স্ত্রীকে ঘোড়ায় চড়ে শহরে ভ্রমণে বেড়িয়েছিলেন। তখন প্রজারা তাদের দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিল যে, একজন মিষ্টির কারিগর নববধূর আকারে একটি মিষ্টির পুতুল তৈরি করে খলিফাকে উপহার দিয়েছিলেন। সেই থেকেই এ দেশে আরুসাত আল-মোলিদ” প্রচলন শুরু হয়। বেশিরভাগ মিশরীই মনে করেন এর সাথে ধর্মীয় কোন সম্পর্ক নেই।

ফাতেমীয় যুগের আরেকটি জনশ্রুতি ছিল যে, যুদ্ধ থেকে ফিরে আসা সৈন্যরা তাদের সাহসিকতার পুরস্কার হিসেবে সুন্দরী বধূদের বিয়ে করবে; সৈন্যদের প্রত্যাবর্তনকে সম্মান জানাতে প্রতি বছর মিষ্টি পুতুলও তৈরি করা হয়েছিল।

 কায়রোর প্রাচীনতম একটি মিষ্টি কারখানায় ঈদে মিলাদুনবী (স.) উপলক্ষে ঐতিহ্যবাহী মিষ্টিরপুতুল তৈরি করা হচ্ছে। ছবি : সংগৃহীত
কায়রোর প্রাচীনতম একটি মিষ্টি কারখানায় ঈদে মিলাদুনবী (স.) উপলক্ষে ঐতিহ্যবাহী মিষ্টিরপুতুল তৈরি করা হচ্ছে। ছবি : সংগৃহীত

স্থানীয় লোককাহিনী এবং উদযাপনের ভালবাসা ফাতেমিদের সময় থেকে এখন পর্যন্ত মোলিদ আল-নবীর ঐতিহ্য সংরক্ষণে সহায়তা করেছে। বছরের পর বছর ধরে, এই ঐতিহ্য বেড়েছে এবং মিষ্টি কারিগররা আকর্ষণীয় রূপ এবং রঙের সাথে পুতুলের ভাস্কর্যকে নিখুঁত করেছে।

ঐতিহ্যগতভাবে,এই মিষ্টিগুলি সাধারণ উপাদান থেকে তৈরি করা হয়েছিল- প্রধানত মধু, চিনি এবং জেলটিন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, অনেক মিষ্টি কারিগর তাদের মধ্যে আরও উপাদান যুক্ত করেছে।

কায়রোর বাব আল-বাহর এলাকায় ৩৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে মিষ্টির কারিগর মোহাম্মদ এল-শেনাউই জানান,”মিষ্টিগুলি, চিনিসহ উপাদনগুলো ফুটন্ত পয়েন্টে পৌঁছানো পর্যন্ত উত্তপ্ত হয় যাতে এটি তরণ মিশ্রন হয়ে যায়। তারপরে এটি একটি কাঠের ছাঁচে ঢেলে দেওয়া হয় যা একটি পুতুল বা ঘোড়ার আকার নেয়।

‘মিষ্টিগুলি ছাঁচে শক্ত হয়ে গেলে, সেগুলি সরানো হয় এবং নকশায় ভাঁজ করা কাগজের রঙিন সিট দিয়ে সজ্জিত করা হয,”তিনি যোগ করেন।

ঈদে মিলাদুন্নবীর ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির পুতুল তৈরি করছেন একজন মিশরীয় মহিলা। ছবি : সংগৃহীত
ঈদে মিলাদুন্নবীর ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির পুতুল তৈরি করছেন একজন মিশরীয় মহিলা। ছবি : সংগৃহীত

মিষ্টি তৈরি করার সময় কিছু নিয়ম মেনে চলার কথাও জানান এল-শেনাউই। বলেন, “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলির মধ্যে একটি হল মিশ্রণটি নাড়াচাড়া করা যাতে এটি পুড়ে না যায়। তারপর অল্প অল্প করে পানি যোগ করা। মিষ্টিগুলি তামার পাত্রে তৈরি করা দরকার কারণ অ্যালুমিনিয়ামগুলি মিশ্রণের সাথে বিক্রিয়া করে এবং এটি কালো হয়ে যায়”।

বেশিরভাগ মিষ্টির দোকানগুলি তাদের সমস্ত গ্রাহকদের জন্য পর্যাপ্ত স্টক করার সময় আছে তা নিশ্চিত করার জন্য এক মাস আগে ছুটির জন্য প্রস্তুতি শুরু করে।

যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলিতে মিশরে খাদ্য ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকে এবং মাওলিদ মিষ্টির দামও বেড়েছে – মিশরের অনেক মুসলমান এখনও তাদের পরিবারের সাথে উপভোগ করা একটি আনন্দদায়ক ঐতিহ্য রক্ষা করার জন্য মিষ্টি কেনা উপভোগ করে।

নকশায় ভাঁজ করা কাগজের রঙিন শিট দিয়ে আকর্ষণীয় রূপ এবং রঙের সাথে পুতুলের ভাস্কর্যকে নিখুঁত করে কারিগররা। ছবি : সংগৃহীত
নকশায় ভাঁজ করা কাগজের রঙিন শিট দিয়ে আকর্ষণীয় রূপ এবং রঙের সাথে পুতুলের ভাস্কর্যকে নিখুঁত করে কারিগররা। ছবি : সংগৃহীত

এ সব মিষ্টির পুতুল মিশরের শিশুদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সারা দেশের বাজারে পুতুলের বার্ষিক আগমনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে, মিষ্টি স্বাদে লিপ্ত হওয়ার জন্য উত্সাহের সঙ্গে তাদের টুকরো টুকরো করে।

ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে ১২ রবিউল আওয়াল এর দু-তিন দিন আগে থেকেই সারা মিশর জুড়ে চলে মিষ্টি বিতরণ। স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের হালাওয়েত আল-মোলিদ মিষ্টি বিতরণ করা হয় স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। পাড়া প্রতিবেশীরাও একজন আরেকজনকে মিষ্টি উপহার দেন।

এইসব আয়োজন মূলতঃ জাতীয়ভাবে মুসলিম পরিবারে ও সমাজের পরবর্তী প্রজন্ম ছোট ছোট বাচ্চাদের কাছে মানবতার শ্রেষ্ঠতম রহমত দয়াল নবীজীকে অত্যন্ত আনন্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়াই এর অন্যতম উদ্দেশ্য।

মিশরে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় দোবকানে দোকানে মোলিদ মিষ্টির পসরা
মিশরে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় দোবকানে দোকানে মোলিদ মিষ্টির পসরা

ইদানিং অনেক দোকানে, বিশেষ করে বড় শহরে ভোজ্য চিনির পুতুলকে প্লাস্টিকের সংস্করণ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে দেখা যায়।

আগেই বলছি এটি মিশরের একটি জাতীয় দিবস। সরকারী ছুটির এই দিনে এখানে সম্মিলিত বাহিনীর কুচকাওয়াজ হয়। আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে মিশরীয় রাষ্ট্রপতি এবং আল আযহার এর গ্র্যান্ড ইমাম দেশের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ উপযুক্ত ব্যক্তিদের হাতে তুলে দেন জাতীয় পদক।

আকাশযাত্রার ফেসবুক পেইজে যোগ দিতে চাইলে এখানে ক্লিক করার অনুরোধ

মিলাদুন্নবীর দিনে অনেক মিশরীই রোজা রাখেন ও অতিরিক্ত সময় ধরে পবিত্র কোরআন তিলওয়াত ও সুন্নত নামাজ আদায় করেন। তবে কোন মসজিদ বা অন্য কোথাও দাঁড়িয়ে মিলাদ কায়েম করতে দেখা যায় না।

এই দিন সন্ধ্যার পর অনেক মিশরীয় পরিবারকে দেখা যায়, ঘরে রুজ-বিল্লাবান (দুধ পায়েস) তৈরি করে ছোট ছোট পাত্রে রাস্তায় মানুষের মধ্যে বিতরণ করতে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!