বাংলাদেশ স্কুল মাস্কাট : নতুন নেতৃত্বে পুনর্জাগরণের প্রত্যাশা
ওমানপ্রবাসী বাংলাদেশিদের হৃদয়ের এক উজ্জ্বল নাম— বাংলাদেশ স্কুল মাসকাট, বাংলাদেশ কমিউনিটির গৌরব, সংগ্রাম ও ঐক্যের প্রতীক। ১৯৯৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) আমিন আহমেদ চৌধুরী, বীর বিক্রম-এর দূরদৃষ্টি, প্রবাসী বাংলাদেশি রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের আর্থিক অবদান, বাংলাদেশ সোশ্যাল ক্লাবের তৎকালীন নেতৃত্বের সক্রিয় সহযোগিতা এবং ওমানের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের মাধ্যমে জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশিদের প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। ওই বছর ৯ নভেম্বর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়, আর সেই থেকে সফল যাত্রা।
প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক রবার্ট কুসওয়ার্থ, যিনি ১৯৯৬ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৯৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে একে একে দায়িত্ব ছিলেন বাংলাদেশের শিক্ষা, প্রশাসন ও সশস্ত্রবাহিনীর অভিজ্ঞ কর্মকর্তা এবং শিক্ষাবিদরা। তাঁদের পরিশ্রম, স্বপ্ন ও ত্যাগের ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে উঠেছে আজকের এই বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বর্তমানে প্রায় এক হাজার প্রবাসী পরিবারের সন্তান বাংলাদেশ স্কুল মাসকাট অধ্যয়নরত।
প্রশাসনিক উদ্যোগের বাইরে, এই স্কুলের গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে প্রবাসী রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের ঘাম, ত্যাগ আর ভালোবাসার গল্প। ১৯৯৫ সাল থেকে প্রবাসীরা দূতাবাসের বিভিন্ন সেবা নেওয়ার সময় বিশেষ করে প্রতিটি পাসপোর্টে অতিরিক্ত ৫ রিয়াল করে, দুই দফায় মোট ১০ রিয়াল করে চাঁদা দিয়েছেন স্কুল ভবন নির্মাণের তহবিলে— টানা দশ বছর। সেই অর্থে আজও অনুরণিত হয় তাঁদের শ্রমঘাম মেশানো অবদান ও আন্তরিকতার গল্প। একই সঙ্গে নানা সময়ে বাংলাদেশ কমিউনিটির বিত্তবান, সংগঠক আর প্রবাসী সংগঠনগুলোও এই উদ্যোগকে আর্থিক সহায়তা ও মনোযোগ দিয়ে আরও মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছে। তাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই প্রবাসী বাংলাদেশিদের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে ওমানের মাটিতে বাংলাদেশের ঐক্য, শিক্ষা ও স্বপ্নের প্রতীক।
বাংলাদেশ স্কুল মাসকাট পরিচালিত হয় ওমানের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী, বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতায় এবং অভিভাবকদের ভোটে নির্বাচিত একটি পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে। এই পর্ষদে থাকেন— নির্বাচিত ৫ জন অভিভাবক প্রতিনিধি, বাংলাদেশ দূতাবাস মনোনীত ৩ জন সদস্য ( ১ জন কর্মকর্তা, ২ জন উচ্চশিক্ষিত প্রবাসী প্রতিনিধি) এবং অধ্যক্ষ (কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে)। প্রতি দুই বছর পরপর সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয় নতুন পরিচালনা পর্যদের ৫ জন অভিভাবক প্রতিনিধি। তাদের মধ্য থেকে ভোটের মাধ্যমে একজন পরিচালনা পর্যদের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। 
আগামীকাল— ৩১ অক্টোবর শুক্রবার, সেই দায়িত্ব পালনের নতুন অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ স্কুল মাসকাটের পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অভিভাবক প্রতিনিধি হিসেবে ৫ টি পরিচালক পদে ৭ জন প্রতিদ্ধন্দিতা করছেন, সবাই যোগ্য প্রার্থী, কমিউনিটির উজ্জ্বল মূখ। এবারের নির্বাচন ঘিরে প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটিতে ইতিমধ্যেই নতুন আশার আলো দেখা দিয়েছে-যার পেছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আর যারাই নির্বার্চিত হয়ে আসবেন তাদের সামনে থাকবে অনেক চ্যালেঞ্জ।
বর্তমানে বাংলাদেশ স্কুল মাসকাট নানামুখী সংকট ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান, প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও সুযোগ-সুবিধা, সার্বিক শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, আর্থিক স্থিতি— সবকিছুই এখন গভীর মনোযোগ দাবি করছে। নতুন স্থানে আধুনিক মানের স্কুল ভবন নির্মাণ, বিদ্যালয়ের পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং বাংলাদেশের ন্যাশনাল কারিকুলাম ইংলিশ ভার্সন চালুর মতো উদ্যোগগুলোও এখন সময়ের দাবি।
একসময় লেখাপড়ার মান খুবই ভাল ছিল, অনেক সুনাম ছিল। এখন এ নিয়ে অভিভাবকদের অসন্তোষ রয়েছে, যদিও ভাল অনেক শিক্ষক আছে। এর বাইরেও স্কুলটি নানা সমস্যা ও জটিলতায় জর্জরিত— শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি সংক্রান্ত অসন্তোষ, শিক্ষার্থীদের আচরণগত সমস্যা, সময়মতো অডিট না হওয়া, আর্থিক অপচয় এবং কার্যকর জবাবদিহিতার অভাব ইত্যাদি বিষয় অভিভাবকদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। অনেক কারণে বিরক্ত ওমানের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও। বিভিন্ন সময়ে অভিভাবকদের অনেক অভিযোগ জমা পড়ে মন্ত্রণালয়। এছাড়া, অনেক সময় দেখা গেছে, পরিচালনা পর্ষদে নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ ও বিভাজন স্কুল পরিচালনায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অথচ এই স্কুল আমাদের জাতীয় মর্যাদার প্রতীক— এখানে কোনো আঞ্চলিকতা, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা বা স্বার্থের স্থান থাকার কথা নয়। 
তবু একটি বিষয় স্মরণযোগ্য— স্কুল পরিচালনায় যারা যুক্ত, তারা সবাইই নিঃস্বার্থভাবে কাজ করা সেচ্ছাসেবী মানুষ। সমাজের উন্নতির জন্য তারা নিজেদের মূল্যবান সময় ও শ্রম ব্যয় করেন। সবাই সমানভাবে সফল নাও হতে পারেন, কিন্তু তাঁদের চেষ্টাকে অবমূল্যায়ন করা যায় না। বিদায়ী কমিটির প্রতিটি সদস্য, হয়তো সীমাবদ্ধতা ও বাধা সত্ত্বেও, ভালো কিছু করার চেষ্টা করেছেন। ১৯৯৫ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত যারা এই বিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও টিকে থাকার জন্য ঘাম ঝরিয়েছেন, সময় ও শ্রম দিয়েছেন— তাঁদের প্রতি জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা ও সালাম। তাঁদের অবদানেই আজও বাংলাদেশ স্কুল মাসকাট প্রবাসী বাংলাদেশিদের শিক্ষাগত গর্বের প্রতীক হয়ে টিকে আছে।
ওমানে বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রদূত রিয়ার অ্যাডমিরাল খন্দকার মিসবাহ-উল-আজিম মহোদয়ের নেতৃত্বে ইতিমধ্যেই কমিউনিটিতে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। স্কুল নিয়ে অভিভাবকরা নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। মান্যবর রাষ্ট্রদূত স্কুলের উন্নয়ন নিয়ে খুবই আগ্রহী। এ লক্ষ্যে ওমানের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছেন। বছরের পর বছর যেখানে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষে স্কুল চলেছে, সেখানে একজন বিদেশি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত অধ্যক্ষ নিয়োগ দিয়েছেন। ইতোপূর্বে সামরিক ও বেসামরিক অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এ শীর্ষ কর্মকর্তার। আমার বিশ্বাস, তাঁর কূটনৈতিক দক্ষতা, শিক্ষা অভিজ্ঞতা এবং কমিউনিটির প্রতি আন্তরিকতা বাংলাদেশ স্কুল মাসকাটকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেবে।
এই মুহূর্তে দরকার ঐক্য, স্বচ্ছতা ও টিমওয়ার্ক। নতুন কমিটির সদস্যদের জন্য কাজের পরিধি যেমন বিশাল, তেমনি সম্ভাবনাও অসীম। সংকট ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলাসহ সবকিছুতেই প্রয়োজন সমন্বিত প্রচেষ্টা ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। মান্যবর রাষ্ট্রদূতের দিকনির্দেশনা, অভিভাবকসহ বাংলাদেশ কমিউনিটির আকুন্ঠ সমর্থন আর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্তরিকতায় নতুন পর্যদ বাংলাদেশ স্কুলকে আগের চেয়েও ভাল একটা অবস্থায় আনতে পারবে বলে আমরা আশাবাদী।
আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগে যে স্বপ্নের বীজ বপন করেছিলেন মেজর জেনারেল আমিন আহমেদ চৌধুরী বীর বিক্রম, সেই স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব এখন আমাদের এবং নতুন প্রজন্মের কাঁধে। যদি আমরা সবাই একসঙ্গে, এক লক্ষ্য নিয়ে, এক হৃদয়ে কাজ করতে পারি— তবে খুব শিগগিরই বাংলাদেশ স্কুল মাসকাট আবারও হবে ওমানে বাংলাদেশি গৌরবের উজ্জ্বল প্রতীক। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ স্কুলের মর্যাদা, আমাদের দেশের মর্যাদা, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আলোকিত আগামী। সুতরাং, আসুন— বিভাজন নয়, ঐক্যের পথে হাঁটি। ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে সবাই মিলে গড়ে তুলি একটি আন্তর্জাতিকমানের বাংলাদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
লেখক : সৈয়দ মোহাম্মদ মনজুরুল ইসলাম– সাবেক জয়েন্ট সেক্রেটারি বাংলাদেশ সোশ্যাল ক্লাব ওমান এবং প্রতিষ্ঠাকালীন আহবায়ক (ড্রেস কোড কমিটি), বাংলাদেশ স্কুল মাস্কাট
[প্রিয় পাঠক, আকাশযাত্রা মতামত ও প্রবাস বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকসহ কমিউনিটি ও সংগঠনের নানান খবর, ভ্রমণ, আনন্দ-বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। লেখা ছবিসহ মেইল করুন [email protected] এই ঠিকানায়]


