প্রবাসে নিঃসঙ্গ ঈদ: ভিডিও কলে আনন্দ-অশ্রু ভাগাভাগি

খুশির ভেতরেও লুকিয়ে থাকে এক অদৃশ্য ক্লান্তি- প্রবাসের ঈদ মানেই এমনই ভিন্নতর অনুভূতি। ঈদের সকাল আসে, নতুন দিনের আলো ছুঁয়ে দেয় প্রবাসী হৃদয়কে, কিন্তু সেই আলোয় নেই মায়ের হাতের ছোঁয়া, বাবার চোখের স্নেহ, ভাইবোনের কোলাকুলির উষ্ণতা। হাজার মাইল দূরে বসে প্রিয়জনদের স্মৃতি যেন আরও গভীর করে তাড়া করে ফিরে।

বহু প্রবাসী ঈদের দিনেও ছুটি পান না—কারখানা, রেস্তোরাঁ, নির্মাণসাইট বা ডেলিভারির ব্যাগ কাঁধে করেই কেটে যায় তাদের ঈদের সকাল। কারও কারও জামাতে নামাজ পড়াই হয়ে ওঠে না, কেউ কেউ রাস্তার এক কোণে দাঁড়িয়ে আদায় করেন ফরজ। চারপাশে থাকে না কোনো চেনা মুখ, থাকে না ঈদের আলিঙ্গনের উত্তাপ—থাকে শুধু দায়িত্ব আর দূরত্ব। ভিডিও কলের পর্দায় খুঁজে নিতে হয় মায়ের চোখের পানি, সন্তানের মুখের হাসি।

এই যেন নিঃসঙ্গতা, ত্যাগ আর অপেক্ষার নাম ঈদ।

Travelion – Mobile

গ্রিসের এথেন্স শহরের ওমোনিয়া এলাকার একটি বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টে দেখা গেল এমনই কিছু দৃশ্য—কয়েকজন প্রবাসী একসঙ্গে বসে ভিডিও কলে পরিবারের সঙ্গে কথা বলছেন। কারও চোখে আনন্দ অশ্রু, কারও মুখে কৃত্রিম হাসি, আর হৃদয়ে চাপা ব্যথা—এই হলো তাদের প্রবাসের ঈদ।

গ্রিসে ঈদের জামাত শেষে প্রবাসী বাংলাদেশি নারী নিলা রহমানের অনুভূতি শুনছেন লেখক।
গ্রিসে ঈদের জামাত শেষে প্রবাসী বাংলাদেশি নারী নিলা রহমানের অনুভূতি শুনছেন লেখক।

আলাপচারিতায় গ্রিস প্রবাসী রফিকুল ইসলাম বলেন, “এ নিয়ে টানা দশটি ঈদ কাটালাম পরিবারের বাইরে। সকালে উঠে আব্বা-আম্মার জন্য দোয়া করি। নামাজ পড়ে চোখ ভিজে যায়। মনে হয়, কেন এত দূরে এলাম?”

প্রবাসী জুবায়ের আহমেদ বলেন, “কোনো কোনো বছর তো ঈদের দিনও কাজে থাকতে হয়। সবাই যখন জামাতে নামাজ পড়ে, আমরা তখন ডিউটিতে। ফোনে মা কান্না করে বলেন, ‘তুই কি ঈদের নামাজ পড়লি?’ আমি চুপ করে থাকি। প্রবাসে ঈদের দিনটা মানুষকে আরও নিঃসঙ্গ করে তোলে।”

গ্রিসের এক দ্বীপে রেস্তোরাঁয় কাজ করেন অলিউর রহমান। এবারের ঈদে তিনি রাজধানী এথেন্সে এসে বাংলাদেশিদের সঙ্গে ঈদের জামাতে অংশ নিয়েছেন। তিনি বলেন, “গ্রিসে হাজারো মানুষের মাঝে থেকেও ঈদের দিন নিজেকে সবচেয়ে একা লাগে। এমন এক জায়গায় থাকি, যেখানে কেউ এসে বলে না—‘ঈদ মোবারক’, কেউ জড়িয়ে ধরে না।”

Diamond-Cement-mobile

এথেন্সের জামাতে অংশ নিয়েছেন বহু প্রবাসী বাংলাদেশি নারীও। তাদের জন্য ছিল আলাদা নামাজের ব্যবস্থা। নামাজ শেষে কথা হয় প্রবাসী বাংলাদেশি নারী নিলা রহমানের সঙ্গে, অনুভূতি জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, “নামাজে এসে কিছুটা ভালো লাগছিল। অনেক দিন পর অনেক বাংলাদেশিকে একসঙ্গে দেখলাম। কিন্তু নামাজ শেষে যখন সবাই চলে গেল, তখন হঠাৎ করেই মনে হলো—আমি আবার একা। দেশে থাকলে এই সময়টায় মায়ের হাতের রান্না, বোনের সঙ্গে গল্প, সবার কোলাকুলি পেতাম। এখানে ঈদ মানে স্মৃতির ভার।”

গ্রিসের রাজধানী এথেন্সের ঈদের জামাতে অংশ নিয়েছেন অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি ।
গ্রিসের রাজধানী এথেন্সের ঈদের জামাতে অংশ নিয়েছেন অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি ।

আরও কথা হয় পর্তুগাল প্রবাসী তন্নী আক্তারের সঙ্গে, যিনি এক বছর আগে পারিবারিক ভিসায় প্রবাসে এসেছেন। তিনি বলেন, “নারী হয়ে প্রবাসে থাকা এমনিতেই কঠিন, ঈদের দিন সেই কষ্ট আরও বাড়ে। মা ও বোন ভিডিও কলে বলল—‘তুমি না থাকলে ঈদ ভালো লাগে না।’ তখন আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।”

এসব অনুভবের ভিড়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে—ঈদ শুধু উৎসব নয়, প্রবাসীদের জীবনে তা এক ধরনের নীরব কান্নার নাম। হয়ত বাইরে তারা চোখের জল রাখেন না, কিন্তু ভেতরে বহন করেন হাজারো অনুভবের ভার।

উল্লেখ্য, শুক্রবার ঈদুল আজহা উপলক্ষে প্রবাসী বাংলাদেশিসহ হাজারো মুসলিম ধর্মাবলম্বী এথেন্সের বোটানি এলাকার সরকার অনুমোদিত জামে মসজিদে গিয়ে জামাতে অংশ নেন।

এথেন্সের সরকারি জামে মসজিদ এবং সংলগ্ন মাঠজুড়ে আয়োজন করা হয় বৃহৎ পরিসরে ঈদের নামাজ। সেখানে পুরুষ, মহিলা ও শিশুদের জন্য ছিল আলাদা জামাতের ব্যবস্থা। ঘণ্টার ব্যবধানে একাধিক জামাত অনুষ্ঠিত হয় যাতে সবাই অংশ নিতে পারেন।

বাংলাদেশ কমিউনিটি ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ঈদের জামাতে অংশ নেন এবং নামাজ শেষে উপস্থিত প্রবাসীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। সেই কোলাকুলির মাঝে হয়তো কিছুটা সময়ের জন্য হলেও, স্বজনহীন হৃদয়ে কিছু উষ্ণতা মেখে যায়।

লেখক : গ্রিসপ্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক

YouTube video

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!