শীত ও বসন্তের শান্ত রাতগুলোতে ওমানের উপকূলে দাঁড়ালে এক অবাক করা দৃশ্য চোখে পড়ে—নরম ঢেউগুলো এক অদ্ভুত নীল আলোয় ঝলমল করে ওঠে। এই মনোমুগ্ধকর দৃশ্যকে অনেকে “সমুদ্রের আলোক উৎসব” বলে থাকেন। বিজ্ঞানভাষায় একে বলে বায়োলুমিনেসেন্স বা জীবজ্যোতি, যা সৃষ্টি করে একধরনের অতিক্ষুদ্র সামুদ্রিক জীব—নকটিলুকা সিনটিল্যান্স (Noctiluca scintillans)।
কিন্তু এই নীল আলো যতটা সুন্দর দেখতে, এর পেছনে আছে এক অদৃশ্য ও বিপজ্জনক কাহিনি।
নকটিলুকা সিনটিলান্স একধরনের ডাইনোফ্ল্যাজেলেট, যা এখন ওমান সাগরে সর্বাধিক বিস্তারকারী মাইক্রো শৈবালের প্রজাতিগুলোর একটি। দেখতে প্রাণীর মতো হলেও, এটি সালোকসংশ্লেষণকারী সবুজ শৈবালের সঙ্গে এক বিশেষ জৈবিক বন্ধনে আবদ্ধ। এই অংশীদারিত্বের ফলে এটি সূর্যের আলো থেকেও শক্তি আহরণ করতে পারে।
প্রতিবছর শীতকালীন উত্তর-পূর্ব ও গ্রীষ্মকালীন দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বাতাস সমুদ্রপৃষ্ঠে পুষ্টিকর পদার্থ নিয়ে আসে, যা নকটিলুকার ব্যাপক বৃদ্ধির জন্য আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি করে। ২০–৩০ মিটার গভীর জলরাশিতে, কখনো কখনো পৃষ্ঠেও এই ফুল পাওয়া যায়, বিশেষ করে উত্তর ওমানি উপকূল বরাবর বেশি পাওয়া যায়।
যখন সৌন্দর্য হয়ে ওঠে সতর্কবার্তা
এই বৃদ্ধির চরম রূপকে বলা হয় ক্ষতিকারক অ্যালগাল ব্লুম (Harmful Algal Bloom বা HAB)। এতে পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা ভয়াবহভাবে কমে যায়, যা হাইপোক্সিয়া সৃষ্টি করে—এবং এতে মাছসহ সামুদ্রিক প্রাণীরা শ্বাস নিতে না পেরে মারা যায়।
সুলতান কাবুস বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক বিজ্ঞানী ড. খালিদ আল হাশমি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “নকটিলুকা ফুল জলে অক্সিজেন কমিয়ে দেয়, যা সামুদ্রিক প্রাণীদের জন্য মৃত্যুফাঁদ তৈরি করে। এরা অ্যামোনিয়াও ছাড়ে, যা মাছসহ অন্যান্য জীবের জন্য বিষাক্ত।”
মানব জীবনের উপর প্রভাব
এই ঘটনার প্রভাব শুধুই সমুদ্রে সীমাবদ্ধ নয়। ওমানের মৎস্য শিল্প ক্ষতির মুখে পড়ে, কারণ মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী মারা যায়।
জল বিশুদ্ধকরণ কেন্দ্র—যেমন উপকূলীয় ডিস্যালিনেশন প্ল্যান্ট—ব্লুমের কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে। শৈবালের আস্তরণ রিভার্স অসমোসিস ঝিল্লি আটকে দেয়, ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় এবং পরিশোধন ক্ষমতা কমে।
বিজ্ঞানীদের লড়াই: সমুদ্রের গভীরে অনুসন্ধান
এই ক্রমবর্ধমান হুমকি মোকাবেলায়, UNESCO চেয়ার অফ মেরিন বায়োটেকনোলজি অধ্যাপক সের্গেই ডোব্রেটসভ-এর নেতৃত্বে এক গবেষণা দল চালু করেছে FORCA-HAB প্রকল্প।
উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও উদ্ভাবন মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে পরিচালিত এই উদ্যোগে বিজ্ঞানীরা খুঁজছেন—নকটিলুকা ফুল কীভাবে গঠিত হয়, কীভাবে ছড়ায়, এবং তার প্রভাব কী।
গবেষক হাজির আল লাওয়াতি দেখছেন, ঢেউয়ের বা পানির গতিবিধির কারণে কীভাবে নকটিলুকা আলো উৎপন্ন করে। “আভা যত উজ্জ্বল, ফুল তত ঘন,” তিনি বলেন। “এই নীল জ্যোতি শুধু সৌন্দর্যের নয়, এক প্রাকৃতিক সতর্কবার্তাও বটে।”
সমুদ্রের তলে কী ঘটছে?
সাধারণ স্যাটেলাইট বা ড্রোন অনেক সময় পৃষ্ঠের নিচে থাকা ফুল শনাক্ত করতে পারে না। এজন্য ডঃ গার্ড ব্রাস ব্যবহার করছেন সাগর-গ্লাইডার—মানববিহীন সাবমেরিন, যা ১,০০০ মিটার গভীরে ডুব দিতে পারে এবং তাপমাত্রা, লবণাক্ততা, অক্সিজেন ও ক্লোরোফিল পরিমাপ করতে পারে।
অন্যদিকে, গবেষণার মাইক্রোবায়োলজিক্যাল দিক নিয়েছেন এমএসসি ছাত্রী বুথাইনা আল খাজিরি। তিনি ৮২টি ব্যাকটেরিয়া প্রজাতি শনাক্ত করেছেন, যেগুলোর কিছু নকটিলুকার বৃদ্ধি বাড়ায়, আর কিছু মাছের মৃত্যুতে ভূমিকা রাখে।
“শুধু শৈবাল নয়, এটি একটি জটিল, আন্তঃনির্ভরশীল বাস্তুতন্ত্র,” তিনি বলেন। “যার অনেক কিছুই আমরা এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি।”
শেষ কথা: নীল আলো নয়, প্রকৃতির সতর্ক বার্তা
বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এই গবেষণা ভবিষ্যতে ওমানে ক্ষতিকারক অ্যালগাল ব্লুম পূর্বাভাস ও প্রতিরোধে সহায়ক হবে। জলবায়ু পরিবর্তন ও উপকূলীয় উন্নয়নের ফলে সমুদ্রের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, এবং এখন সময়—এই বিপদের গভীরতা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার।
সমুদ্রের ঝিকিমিকি আলো পর্যটকদের মোহিত করলেও এর তলদেশে রয়েছে প্রকৃতির এক স্পষ্ট বার্তা— সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য হতে পারে সবচেয়ে বিপজ্জনক সতর্কতা।
সব খবর জানতে, এখানে ক্লিক করে আকাশযাত্রার ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে যুক্ত থাকার অনুরোধ